ইসলামে স্বদেশপ্রেম ও বিজয় 

স্বদেশপ্রেম মানবপ্রকৃতির অংশ। অসংখ্য হাদিস থেকে দেশপ্রেমের নির্দেশনা পাওয়া যায়। হিজরতের সময় প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা মুকাররমা ছেড়ে যাওয়ার সময় মহানবী (সা.) অশ্রুসিক্ত হন এবং পবিত্র এ ভূমিকে সম্মোধন করে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! তুমি (মক্কা) আল্লাহর গোটা জমিনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং দুনিয়ার সব ভূমির মধ্যে তুমি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আল্লাহর শপথ! তোমার থেকে আমাকে বের করে দেওয়া না হলে আমি চলে যেতাম না।’ (নাসায়ি শরিফ, হাদিস : ৩১০৮)। 
মক্কা ছেড়ে যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) মদিনার পথে ছাওর গুহায় আশ্রয় নেন, তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে বারবার তিনি মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন। প্রিয় হাবিবের হৃদয়ের এরূপ ব্যাকুলতা দেখে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই যিনি আপনার জন্য কোরআনকে বিধান করেছেন, তিনি আপনাকে অবশ্যই জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৮৫)। 
নিজ মাতৃভূমিকে বিশ্বনবী (সা.) এতোটাই ভালোবাসতেন যে, শত কষ্ট দেওয়া সত্ত্বেও যিনি সবসময় উম্মতের কল্যাণের জন্য দোয়া করতেন, সেই তিনিই ওই লোকদের জন্য বদদোয়া করেছেন, যারা তাঁকে মক্কা ছাড়তে বাধ্য করেছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি শায়বা ইবনু রাবিআ, উতবা ইবনু রাবিআ এবং উমাইয়া ইবনু খালফের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করুন; যেমনিভাবে তারা আমাদের মাতৃভূমি থেকে বের করে মহামারির দেশে ঠেলে দিয়েছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৯)। 
মাতৃভূমির আরবি প্রতিশব্দ ‘ওয়াতান’। বহুবচনে মাওয়াতিনু। শব্দটি পবিত্র কোরআনে মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়েছে। তবে তা মাতৃভূমি অর্থে নয়; সাধারণ জায়গা অর্থে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বহু স্থানে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ২৫) কোরআনের একাধিক জায়গায় স্বদেশ ও মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেও তাতে সরাসরি দেশপ্রেমের কথা উল্লেখ নেই। কারণ হলো- যা শুরুতেই বলা হয়েছে যে, দেশপ্রেম মানবপ্রকৃতির অংশ। কোরআনে একাধিক স্থানে সন্তানকে মা-বাবার প্রতি উত্তম আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাবা-মাকে সন্তানের প্রতি ভালো আচরণ করার নির্দেশ তাতে দেওয়া হয়নি। কেননা, সন্তানের ভালোবাসাও মানবপ্রকৃতির অংশ। 
দেশপ্রেম, দেশের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা একজন মুমিনের সার্বক্ষণিক বৈশিষ্ট। কিন্তু এরপরও বিশেষ কিছু সময়ে দেশপ্রেমের আলোচনা ও চর্চা হয়। যেকোনও ইতিবাচক বিষয়ের আলোচনা ও নসীহত মুমিনের উপকার করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং নসীহত করতে থাক, কারণ নসীহত মুমিনদের উপকারে আসে।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৫৫) আজ ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। এই দিনেই আমরা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ৬৬ হাজার বর্গ মাইলের এই ভূখণ্ডটি অর্জন করেছিলাম। এজন্য দেশপ্রেম ও বিজয় সম্পের্কে আজকে এই আলোচনা। 
পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল অধিকার আদায় নিয়ে। যারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য যুদ্ধ করে নিহত হন, হাদিসে তাদেরকে শাহাদাতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ; যে ব্যক্তি তার জীবন রক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার ধর্ম রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ।’ (তিরমিজি শরিফ) শহীদ ও গাজিরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যেসব সূর্য সন্তান আমাদের মাতৃভূমির বিজয়ের জন্য লড়াই করেছেন তাদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। 
বিজয়ের মুহূর্তেও আমাদের করণীয় সম্পর্কে বলে দিয়েছে ইসলাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন; তিনি তো তওবা কবুলকারী।’ (সুরা নাসর) এজন্য স্বাধীনতা ও বিজয় প্রাপ্রিতে আমাদেরও সঠিক পদ্ধতিতে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ। 
আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন মক্কা বিজয় করলেন, তখন মক্কায় প্রবেশ করে তিনি যা করেছিলেন, সেটিও আমাদের জন্য বিজয়ের শিক্ষা। হজরত ইমাম জাওজির বর্ণনায়, আল্লাহর নবী (সা.) উষ্ট্রীর ওপর আরোহিত ছিলেন, তাঁর চেহারা ছিল নিম্নগামী। বিনয়ের সাথে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন, সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয় ‘সালাতুল ফাতহ’ বা বিজয়ের নামাজ। এরপর নবীজি (সা.) হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, হে মক্কাবাসী! বিগত ২১ বছর ধরে তোমরা আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবাদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছ, আজ আমি তার কোনো প্রতিশোধ নেব না। মহানবী (সা.) আরও বললেন, আজ আমি তোমাদের সবার জন্য হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। (সুনানে বায়হাকি, খণ্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ১১৮)।

লেখক: শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আলইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।