চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে

চট্টগ্রামে কমতে শুরু করেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। আগে যেখানে দৈনিক দেড়শ’ থেকে ২শ’ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতো বর্তমানে সেখানে ভর্তি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ জন। চিকিৎসকরা বলছেন, শীত বাড়তে থাকায় ডেঙ্গুর জীবাণু বাহক এডিস মশার উপদ্রব কমছে। ফলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমছে। চলতি বছর জুলাই থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার বাড়তে শুরু করেছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এবার চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের মতো চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ অতীতে আর দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা। ঘরে ঘরে ছড়িয়েছিল এ রোগ। রোগী বেড়ে যাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোলা হয় পৃথক কর্ণার।

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের অব্যবস্থাপনা মশা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তবে সিটি করপোরেশন কর্মকর্তারা বলছেন, মশা নিধনে নিয়মিত কার্যক্রম চলমান ছিল, এখনও আছে। এই কার্যক্রম সারা বছরই অব্যাহত থাকে।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে তিন হাজার ১৬০ জন। ওই বছরগুলোতে মারা গেছেন ১৩ জন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১৩৫ জন, ২০১৭ সালে ১১৭ জন। ২০১৮ সালে ৭২ জন আক্রান্ত এবং একজন মারা যান। ২০১৯ সালে দুই হাজার ৫৪৮ জন আক্রান্ত এবং সাত জন মারা যান। ২০২০ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ জন। ২০২১ সালে ২৭১ জন আক্রান্ত এবং পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পাঁচ হাজার ৪৩৮ জন। একই সময়ে মারা গেছেন ৪১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে চার জন, মার্চে এক জন, এপ্রিলে তিন জন, জুনে ১৯ জন, জুলাইয়ে ৬৪ জন, আগস্টে ১১৪ জন, সেপ্টেম্বরে এক হাজার ৮৬১ জন, নভেম্বরে দুই হাজার সাত জন এবং ডিসেম্বরে ৭৫৭ জন।

একই সময়ে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৪১ জনের মধ্যে সেপ্টেম্বরে তিন জন, অক্টোবরে ১১ জন, নভেম্বরে ১৯ জন ও ডিসেম্বরে আট জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৪১ জনের মধ্যে ১৪ জন পুরুষ, ১৪ জন নারী এবং ১৩টি শিশু রয়েছে।’

মিনহাজুল ইসমাম নামে নগরীর আগ্রাবাদ ডেবারপাড়া এলাকার একজন বাসিন্দা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও  মশার উপদ্রব কমেনি। দিনের বেলায় কম থাকলেও সন্ধ্যা নামলে মশার উৎপাত খুব বেশি বেড়ে যায়। মশার ওষুধ ছিটাতে সিটি করপোরেশনের অবহেলার কারণে নগরজুড়ে মশার উৎপাত বেড়েছে। ফলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। নগরীর প্রতিটি খাল-নালা বন্ধ রয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজের কারণে খাল-নালাগুলোতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। পানি জমে থাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। সিটি করপোরেশনের অব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার বেড়েছে।’ চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মশা নিধনে কার্যকর ওষুধ স্প্রে করার পাশাপাশি বাসাবাড়ির আশেপাশে নালা নর্দমা, খাল, নদী ইত্যাদি পরিষ্কার রেখে পানি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে যাতে বাড়ির আশেপাশের নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর কিংবা নতুন কীটনাশক কেনার পর সিটি করপোরেশন কর্তৃক অবশ্যই এর কার্যকারিতা যাচাই করা জরুরি।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বছরের মতো এতো বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী অতীতে আর কোনও সময় দেখা যায়নি। এবার ডেঙ্গু অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ বছর জুলাই থেকে উপদ্রব বেড়েছে। অন্যান্য বছর সেপ্টেম্বরের দিকে ডেঙ্গু কমে যায়। এবার ডিসেম্বরেও  এটি অব্যাহত রয়েছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু মশার বাহক এডিস মশার উপদ্রব কমে আসবে বলে আশা করা যায়।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘নগরীর মশক নিধনের জন্য কার্যকর ওষধ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের মশক নিধনে নানা কর্মসূচি অব্যাহত আছে। এই কর্মসূচি যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা তদারকির জন্য কাউন্সিলরদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আবুল হাশেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি বছর ডেঙ্গুর উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরাও উদ্বিগ্ন। অন্যান্য বছর এতো দীর্ঘ সময় ধরে ডেঙ্গুর দাপট ছিল না। এ বছর দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি প্রতিরোধে জনবল ও সরঞ্জাম বাড়ানো হয়েছে। ওষুধ স্প্রে বেড়েছে। নগরবাসীর মাঝে সচেতনতায় লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।’