দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে পুলিশ

সাংবাদিক হাবীব রহমানের ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুর ঘটনায় এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। তার পরিবারের পক্ষ থেকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ করা হলেও মামলার চার নম্বর তদন্ত কর্মকর্তা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু উল্লেখ করে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া কথা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘অপমৃত্যুর মামলাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তার মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনাজনিত কারণে। ময়না তদন্ত রির্পোটেও তাই আসছে। এসব বিষয় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন শিগগিরই আদালতে জমা দেওয়া হবে।’

ভিসেরা রিপোর্ট আসছে কি না, জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার জানামতে ভিসেরার জন্য আবেদন করা হয়নি। তারপরও নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে। আমি বাইরে আছি, পরে বিস্তারিত বলতে পারবো।’

গত বছরের ১৮ জানুয়ারি দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল সিদ্দিক মাস্টারের ঢাল এলাকায় ‘রহস্যজনক’ভাবে মৃত্যুর পর স্বজনরা অভিযোগ করেন, হাবীব রহমানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে এক বছরেও এই মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, যে পথ দিয়ে হাবীর রহমান বাসায় যাচ্ছিলেন, ওই সময় সেখানে বেলচা হাতে কয়েকজনকে দেখা গেলেও তাদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। বেলচা হাতে তিন যুবকের যাওয়ার দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা গেছে। তারপর আরও তিনটি স্থান থেকে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়। দুটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হাবীব রহমান দুটি স্থানে কিছুক্ষণের জন্য থেমেছেন।

আরেকটি ভিডিওতে হাতিরঝিল প্রবেশ করার দৃশ্যে দেখা গেছে, স্বাভাবিকভাবেই মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলেন হাবীব রহমান। ওই সময় থেকে এক মিনিটের পথ পরেই হাবীব রহমানকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

গত বছরের ১৯ জানুয়ারি ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. ফারহানা ইয়াসমিন। গত বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন প্রস্তুতের পর তা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করে ফরেনসিক বিভাগ।

প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা মতামত দেন, ‘আঘাতজনিত কারণেই’ হাবীব রহমানের মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে কোনও বিষক্রিয়া বা অ্যালকোহলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে হাবীবের শরীরের এই আঘাতের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি প্রতিবেদনে, অর্থাৎ হত্যা নাকি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে, তা প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেনি ফরেনসিক বিভাগ।

এ ছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা উল্লেখ করেন, হাবীব রহমানের মৃত্যু আঘাতজনিত। তার চোয়াল এবং নাকের হাড় ভাঙা ছিল। চোয়ালে ২ ইঞ্চি বাই ১ ইঞ্চি ক্ষত পাওয়া গেছে। হেমাটোমা পাওয়া গেছে মস্তিষ্কে, যার আনুমানিক আকার ২ ইঞ্চি বাই ১ ইঞ্চি (হেমাটোমা বলতে সাধারণত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার পর রক্ত জমাট বাঁধাকে বোঝায়)।

ময়নাতদন্ত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেন, হেমাটোমা অনেক ধরনের হতে পারে। তবে এপিডুরাল হেমাটোমা মানে এক ধরনের রক্তক্ষরণ, যা মস্তিষ্কের ডুরা ম্যাটার আবরণী ও কুটির মধ্যবর্তী স্থানে সংঘটিত হয়। হাবীবের মস্তিষ্কের বাম পেরিটাল এবং অপটিক্যাল অঞ্চলে সাবডুরাল এবং সাব আর্চনয়েড হেমারেজ দেখা গেছে। এ ছাড়াও এক থেকে দেড় ইঞ্চি জখম পাওয়া গেছে কপালের বাম পাশে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ওপরের ঠোঁট ও নাকের মধ্যবর্তী স্থানে ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ১ ইঞ্চি প্রস্থের কাটা জখম পাওয়া গেছে, যা মাংস ভেদ করে হাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। নাক-মুখ থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। এ ছাড়া দুই মাড়ির বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে স্থানচ্যুত হয়েছে। জিব কাটা ছিল।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাংবাদিক হাবীব রহমানের মৃত্যুর মূল রহস্য এখনও উদঘাটিত হয়নি। তবে বেশ কিছু ক্লু সংগ্রহ করে তদন্ত চলছে। হাবীব রহমান যেদিন মারা যান, সেই রাতে কোথায় এবং কাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, তাদের বক্তব্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বক্তব্যগুলো ১৬১ ধারায় জবানবন্দি হিসেবে চার্জশিট দেওয়ার সময় আদালতে দেওয়া হবে। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে যারা রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন, তাদেরও জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। ঘটনার দিন র‌্যাবের একটি টহল দল উপস্থিত থেকে হাবীবকে উদ্ধার করে প্রাইভেট কারে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই প্রাইভেট কারে থাকা তিন যুবকেরও জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।

হাবীব রহমানের ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুর ঘটনার পরপরই সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি চত্বরে মানববন্ধন করে কুমিল্লা সাংবাদিক ফোরাম, ঢাকা। ওই সময় মানববন্ধনে সাংবাদিক নেতারা বলেন, হাবীব রহমানের মৃত্যুকে ঘিরে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। দ্রুত তদন্ত করে তার মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করার দাবি জানান সাংবাদিক নেতারা।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) হাবীব রহমানের স্বরণে সময়ের আলোর কার্যালয়ে ও গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় মিলাদ মাহফিল ও দোয়ার আয়োজন করা হবে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান সময়ের আলোর সিনিয়র অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদন এস এম মিন্টু।