বিইআরসি হয়তো তারপরও থাকবে

জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে, এটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু রাজনীতির বিচিত্র গতি সেই স্বাভাবিকতার তোয়াক্কা করে না। গত বছরের মাঝামাঝি একলাফে জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছিল। এরপর এ বছর বিদ্যুতে দাম না বাড়তেই গ্যাসের দামও বাড়লো শিল্প খাতে, যা শেষ অবধি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচই বাড়াবে। পরিবহন ভাড়া হতে জ্বালানির দাম বাড়া, অনেক কিছুর ক্ষেত্রেই মানুষ অতি দ্রুত নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হচ্ছে।

সরকার হয়তো চিন্তা করছে, এই বাড়ানোর পথটা আইনি প্রক্রিয়ায় সুগম করে নিলেই ভালো হয়। তাই সরকারকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০২৩ শীর্ষক একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে যেকোনও পরিস্থিতিকে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-কে পাশ কাটিয়ে সরকার নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াতে পারবে।

জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানোর আগে বিইআরসি গণশুনানি করতো। সেখান গ্রাহক ও বিভিন্ন অংশীজন অংশ নিয়ে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করতেন। এই শুনানিতে অংশগ্রহণকারীদের সব কথা যে গ্রহণ করা হতো তা নয়, তবে মানুষের একটা কণ্ঠস্বর অন্তত ছিল। এই বিল যে সংসদে পাস হবে সেটা নিশ্চিত, কারণ কোনও বিল নিয়েই সংসদে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই বিল যখন আইনে পরিণত হবে তখন মানুষের সেই কণ্ঠটাও হারিয়ে যাবে জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়া থেকে। বিইআরসির ক্ষমতা থাকছে না, থাকছে না মূল্য সমন্বয়ে জনগণের কথা বলার জায়গা।

টাকার দাম পড়ছে। এর একটা মানে হলো, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিছু দিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মসলা, আনাজ, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেতো, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। এখন হুটহাট করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। জ্বালানির দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ে, উৎপাদন খরচ বাড়ে, কাজেই সব জিনিসেরই দাম বাড়ার কথা।

বলা হচ্ছে, আইএমএফের ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদনের শর্ত হিসেবে সরকার এসবের দাম বাড়াচ্ছে। এই ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু থেকে ঋণের শেষ কিস্তি পাওয়া পর্যন্ত সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল পাঁচবার, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় আটবার এবং পানির দাম বাড়ানো হয় পাঁচবার।

সরকার যখন সব সিদ্ধান্তই নির্বাহী আদেশে নিচ্ছে তখন বিইআরসির আর প্রয়োজন কী? এমন একটা প্রশ্ন উঠছে অনেক দিন থেকেই। এরমধ্যেই বেশ কয়েকবার সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। বিইআরসির ওপর আইন-বহির্ভূতভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, তার ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। কমিশন যে সংসদে আইন পাসের আগে থেকেই একটি অকার্যকর সংস্থায় পরিণত হয়েছে– এটি বাস্তবতা।

জ্বালানি খাতে অপব্যবহার, অপচয় ও দুর্নীতির বিষয়টি অনেক দিন ধরে আলোচিত। সে কারণেই জ্বালানি খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ২০০৩ সালে বিইআরসি আইন করা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে এটি কার্যকর হতে শুরু করে। কমিশন শুধু গ্যাস, বিদ্যুৎ ও এলপিজির দাম নির্ধারণ করতো। কমিশনের এখতিয়ারে হলেও জ্বালানি তেলের  দাম নির্ধারণ করতো সরকার নিজেই। এছাড়া বিইআরসির কাছ থেকে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি এলপিজির দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করতো সরকার নিজেই। এখন এই আইনের বলে শুধু বিদ্যুৎ নয়, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যখন খুশি তখন তেল ও গ্যাসের দামও বাড়াতে পারবে।

বিইআরসিকে কোন পর্যায়ে দেখা হয় সেটা সম্প্রতি বোঝা গেলো। বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বিইআরসি গণশুনানি করলো। কমিশন সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগেই সরকার নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ালো। এখানেই বিইআরসির কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ার ঘটনা ঘটলো স্পষ্ট করে। এখন কেউ যদি বলে, কমিশনের ওপর সরকারি, আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের বাস্তব দৃষ্টান্ত এটি, তবে কি ভুল বলা হবে?

নির্বাহী আদেশে একের পর এক দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এমনিতেই অকার্যকর হয়ে রয়েছে। আইনের পর তা সম্পূর্ণ হবে। তবে কী এরপরও সরকার কমিশনকে রাখবে কিছু মানুষের চাকরির জন্য? বিষয়টি জনমনে প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে যারা ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করেন তারা বলছেন, ভোক্তার জ্বালানি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করার আইনি সুযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বিইআরসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সেটা এখন রাষ্ট্র কেড়ে নিচ্ছে।

এ কথা বুঝতে অসুবিধা নেই যে ইচ্ছেমতো যখন তখন দাম বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়াতে সরকার সব আয়োজন সম্পন্ন করছে। কিন্তু এটি কোনোভাবেই জনকল্যাণকর ভাবনা নয়, প্রগতির পথ নয়, বরং পেছনের দিকে যাওয়া। বিইআরসি হয়তো নামে থেকে যাবে, কিন্তু কোনও কাজ আর করতে পারবে না নিজ উদ্যোগে। অদক্ষতা বাড়ানো আর জবাবদিহি কমানোর এমন উদ্যোগ বিরল।

লেখক: সাংবাদিক