‘ম্যানেজ’ করেই চলছে কক্সবাজারের অর্ধশত অবৈধ ইটভাটা

প্রকাশিত: ৭:৪৯ অপরাহ্ণ, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

কক্সবাজারে কৃষি জমি ধ্বংস করে ফসলি জমির পাশেই দেদার গড়ে উঠছে ইটভাটা। কোন নিয়ম নীতি নেই। উৎপাদন অনুমতি নেই। নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। অবৈধ ভাবে ব্যবহার হচ্ছে বিদ্যুৎ। কিছু কিছু ভাটায় পুড়ছে লাকড়ি। শ্রম আইনকে দেখাচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুলি। মনগড়া মত কাটছে ফসলি জমি ও সরকারি জায়গার মাটি। ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি। কিছু জায়গায় ইটভাটা গিলে খাচ্ছে নদী। এক লাইসেন্সেই চলছে ভিন্ন নামের ৪-৫টি ইটভাটা। বৈধ কাগজ না থাকলেও রয়েছেন ভাড়াটিয়া মালিক। মেয়াদ উত্তীর্ণ লাইসেন্সই চড়া দামে চলছে ক্রয়-বিক্রয়।

কাগজের ইটভাটার নামের সাথে ইটের নামের মিল নেই। এমএসআর ব্রিকমিল হয়ে যাচ্ছে এইচএএম ব্রিকস। আবার এক আরএমএল নামের চারটি ব্রিকস চলেছে চার স্থানে। ইটের গায়ের ইংরেজি অক্ষরের সাথে কাগজপত্রে মিল নেই। বেশ কিছু ভাটায় রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। পাহাড়ী এলাকায় ব্যবহার হচ্ছে মনগড়া অবৈধ চিমনি। উড়ছে ধূঁয়া ও বালু।

নষ্ট হচ্ছে বসত ঘরের চাল আসবাবপত্র ও কাপড় চোপড়। রোগাক্রান্ত হচ্ছে ইটভাটা সংলগ্ন বাড়ি ঘরের শিশু সহ নানা বয়সের লোকজন। এ ছাড়া ইট তৈরীর মাটির জন্য দেদার কাটছে ফসলি জমি। ফলে প্রতিদিনই হ্রাস পাচ্ছে চাষাবাদের জমি। প্রভাবশালী কিছু মালিক সরকারি খাস জায়গার মাটি নিচ্ছেন ভাটায়। মোটা অংকের টাকায় সবকিছু রফাদফা করেই এখানে চলছে অর্ধশত ইটভাটা। স্থানীয় প্রশাসন নীরব। ফলে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব।

অভিযোগ উঠেছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে কক্সবাজারের রামু, সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অবৈধ ভাটায় ইট তৈরির কাজ চলছে। অথচ হাইকোর্ট অবৈধ সব ইটভাটা ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিল। আদালতের নির্দেশনা থাকায় নাম মাত্র কয়টি ইটভাটায় লোক দেখানো অভিযান চললেও সবুজে ঘেরা রামু-সদর জুড়ে চলছে অর্ধশতকের বেশি অবৈধ ইটভাটা। এই ইটভাটাগুলো উপজেলা প্রশাসনসহ কয়েকটি দপ্তরকে ম্যানেজ করেই চলছে বলে দাবি ভাটা কর্তৃপক্ষের।

শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরজমিনে রামুর ফঁতেখারকুল ও কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের অবস্থিত অবৈধ আরএমএল, এইচএএম, এমজিএ ব্রিকস এ গিয়ে দেখা যায়, উৎসবের মত ইট তৈরির কাজ করছেন শ্রমিকরা। অবৈধভাবে কৃষকের জমির মাটি কেটে ভাটাগুলোতে পাহাড় সমান উচু করেছে। এছাড়া গত বছর কয়েকটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে ভাঙা হলেও সেগুলো পুনরায় ইট তৈরির কাজ শুরু করেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার জেলায় ৮৮ টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৪২টি ইটভাটার ছাড়পত্র আছে। ৩৫টির ছাড়পত্র বাতিল করা হয়েছে। ১১ টি বর্তমান মৌসুমে বন্ধ রয়েছে। ছাড়পত্র বাতিল করা ভাটাগুলো কোনো রকম বৈধতা ছাড়াই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

কক্সবাজার সদরে ২৭টি ইটভাটায় ১৭, রামুর ৪০টিতে ২৫, পেকুয়ার ৭টির মধ্যে ৪, চকরিয়ার ৫২টির মধ্যে ৩৬ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। উখিয়া-টেকনাফের অধিকাংশ ইটভাটা চলছে অনেকটা গায়ের জোরে।

কুতুবদিয়ার একটি ও মহেশখালীর একটি ইটভাটা চলছে দায়সারাভাবে। এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে গত ২০ নভেম্বর সুপারিশ আকারে ঢাকায় চিঠি প্রেরণ করেছে বলে দাবী করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার অফিস।

অবৈধ ইটভাটাগুলো হলো- কক্সবাজার সদরের পূর্ব খরুলিয়ার শফিউল হক চৌধুরীর মেসার্স এমএস ব্রিক ফিল্ড এমএসব্রিকস ম্যানুফেকচারিং, পিএমখালীর বাংলাবাজারের বজল আহমেদ কোম্পানির বজল অ্যান্ড ব্রাদার্স ব্রিক, চৌফলদন্ডীর হুমায়ুন সিকাদারের মেসার্স আরকেসি ব্রিক, ইসলাবাত ওয়াহেদের পাড়ায় দিদারুল ইসলামের মেসার্স দিবা ব্রিকস, খোদাইবাড়ির জসিম উদ্দিনের কক্স ইন অ্যাসোসিয়েট ব্রিকস, ভোমরিয়া ঘোনার রশিদ আহমদের (বাবুল কোম্পানির) আর এমএম ব্রিকস, ঈদগড় ধলিরছড়ার ইয়াসিন পারভেজ চৌধুরীর মেসার্স এইচবিএম ব্রিকস, চৌফলদন্ডীর রেজাউল করিম সিকদারের আরকেসি ব্রিকস, রামুর মেরংলোয়ার আলহাজ ছাবের আহমদের আল হেরাম ব্রিকস, খুনিয়াপালংয়ের মো. শাহ আলমের মেসার্স এমআরসি ব্রিকস, মধ্যম খুনিয়াপালং মোস্তফা আলমের মেসার্স এসএসবি-২ ব্রিকস, ফতেখারকুল ফরিদুল আলম/জাফর আলমের মেসার্স জেডঅ্যান্ডএফ ব্রিকস, মোস্তাক আহমদের। মেসার্স এসএসবি ব্রিকস, শাহ আলম চৌধুরীর মেসার্স সাবরিনা ব্রিকস, ধোয়া পালং কালু চেয়ারম্যানের মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস, উখিয়ার ঘোনার মেসার্স সাসকো অটো ব্রিবস, খরুলিয়ার জাসমাল হোসেনের মেসার্স বিবিএম ব্রিকস, ধলিরছড়ার ওয়াহিদুজ্জামানের মেসার্স জামান অ্যান্ড ব্রাদার্স, ধোয়াপালংয়ের হাবিবুল ইসলামের মের্সাস এইচএএম ব্রিকস, দক্ষিণ খুনিয়াপালংয়ের মো. শাকেরের মেসার্স রায়ান ব্রিকস, উখিয়ার ঘোনার জাহাঙ্গীর আলমের মেসার্স এরআমএল ব্রিকস, মেরংলোয়ার কামাল মোস্তফার মেসার্স এমকে ব্রিকস।

চকরিয়ার উত্তর হারবাং সামসুল আলমের এলবিএম ব্রিকস, আরিফ উদ্দিনের মেসার্স আশিক ব্রিকস, ফাঁসিয়াখালীর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর মেসার্স জিএলবি ব্রিকস, টৈটং হাজিরবাজার এলাকার আলহাজ আহমেদ নবীর মেসার্স এবিএম ব্রিকস, গয়ালমারার শামসুল আলম কোম্পানির মেসার্স এবিএম ব্রিকস, উত্তরমানিকপুরের শাহাব উদ্দিনের মদিনা ব্রিকস, মানিকপুরের মাহমুদুল হকের আল মদিনা ব্রিকস- ২ এবং এবিএম ব্রিকস, উত্তর মানিকপুরের শাহ আলমের ডায়মন্ড ব্রিকস, রুমখাপালং মো. শাহ আলমের মিডিয়া ব্রিকস ফিল্ড, পাগলির বিল হলদিয়া পালং সৈয়দ উল্লাহর জিএমএস ব্রিকস, থাইং খালীর কেআরবি ব্রিকস, হ্নীলার আলী আহমদের মেসার্স জিয়াউর রহমান ব্রিকস, দৈংগাকাটার মো. আবুল হাশেমের মেসার্স এ হাশেম ব্রিকস, উত্তর হ্নীলার মো. আবদুল্লাহর মেসার্স এ আরবি ব্রিকস ও মেসার্স সালমান ট্রেডিং ব্রিকস, মীর কাশেমের মেসার্স এমকেবি ব্রিকস, হোয়াইক্ষং মো. হাশেমের মেসার্স এএইচবি ব্রিকস, রঙ্গীখালীর মো. শাহজাহান মিয়া চেয়ারম্যানের ফোর স্টার ব্রিকস, লতিয়া খোলার মেসার্স এমআরবি ব্রিকস, হোয়াইক্ষং কবির আহমেদ চৌধুরীর মেসার্স পিবিসি ব্রিকস, কুতুবদিয়া কৈয়ারবিলের মো. শামসুল আলমের মেসার্স এসএ ব্রিক ফিল্ড।

জানা গেছে, গত ১৪ ডিসেম্বর ঈদগাঁও বাস স্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ আরকেসি ব্রিকস এবং ইসলামাবাদ খোদাইবাড়ীর দিবা ব্রিকস নামে দুটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া। এ সময় ভাটা দুটির মালিককে এক লাখ বিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে ইটভাটা পরিচালনা না করতে সতর্ক করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইটাভাটাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ভাটার সর্ম্পূণ অনুমোদন নেই। বেশিরভাগ ভাটারই জেলা প্রশাসনের অনুমোদন থাকলেও নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র। প্রতিবছর ২০ লাখ টন মাটি যায় জেলার ইটভাটাগুলোতে। এমনই এক তথ্য জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। আরও জানা যায়, তারা (ভাটা মালিকরা) জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে ইটভাটা প্রতি বছরের জন্য পরিচালনা করার একটি চুক্তি করে।

উখিয়ার ঘোনার টিলা পাড়ার স্থানীয় যুবক নজিব উল্লাহ জানান, ধুলাবালি মাড়িয়ে চলাচলের কারণে ৭-৮টি গ্রামের স্কুলমুখী শিক্ষার্থীসহ সাধারণ পথচারী মহা বিপাকে। মাদরাসা ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা চরম বিরক্ত। মাদরাসা ও স্কুলে হেঁটে যাওয়ার সময় ধুলার কারণে যেতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ইটভাটার ট্রাক দ্রুতগতিতে ছুটে যাওয়ার সময় কাদাযুক্ত পানি কাপড় নষ্ট করে ফেলে। আমরা বড়রাসহ ছোট ছোট বাচ্চারা রাস্তা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী জমিনে নেমে ওই স্থান অতিক্রম করতে হয়। স্কুল এবং একাধিক গ্রাম ঘেঁষে কয়েকটি ইটভাটা করা হয়েছে আইন না মেনে জনবসতিতে সেইসঙ্গে ফসলের মাঠ এবং এবং ছড়ার পাড়ের মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়।

স্থানীয় আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘ইটভাটার ধুলাবালি ও কালো ধোঁয়ায় কৃষকদের জমির ধানসহ সবজি গাছ মরে যাচ্ছে। এতে লোকসান গুণতে হচ্ছে। গত বছরও বোরো আবাদ করে লোকসানের মধ্যে পড়েছিলেন।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, রামু ও সদর উপজেলার ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের সুপারিশে এই অবৈধ ইটভাটা বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া বাকি অবৈধ ইটভাটা গুলোর বিরুদ্ধেও এমন অনেক অদৃশ্য কারণেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। রামুর আরএমএল ব্রিকসের মালিক রফিক কোম্পানি বলেন, ‘আমরা কীভাবে ইটভাটা চালাই প্রশাসন সব জানে। কারণ তাদের না জানিয়ে ভাটা চালানো সম্ভব না।’

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক অবৈধ ভাটার মালিক বলেন, ‘প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই অবৈধ ভাটা চালিয়ে আসছি। ম্যানেজ না হলে অবৈধ ভাটা এক দিনও চলতে পারবে না। হাইকোর্টের নির্দেশের পর গত বছর অবৈধ ভাটা ভাঙা হয়নি। গতবারের অবৈধ ভাটায় এবারও ইট পোড়ানো হচ্ছে। ভাটার মালিক ও প্রশাসনের যোগসাজশে এটা সম্ভব হয়েছে।’ তার মতে, প্রত্যেক মৌসুমে ভাটা মালিকরা মোটা অংকের একটি চাঁদা দিয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে।

এব্যাপারে রামু ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন কোম্পানির সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে অধিকাংশ ভাটা মালিকের দাবী, তারা প্রত্যেক বছর লক্ষাধিক টাকার উপরে জেলা প্রশাসনকে দিয়ে তাদের ভাটা পরিচালনা করে আসছে।

অবৈধ ইটভাটা বন্ধের পদক্ষেপ বিষয়ে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘৫৪টি অবৈধ ইটভাটার তালিকা করে ঢাকায় এবং জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করেছি। ঢাকা থেকে ইতোমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটি অভিযানে জরিমানা করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘ভাটার লাইসেন্স অথরিটি জেলা প্রশাসকের। তিনি চাইলে লাইসেন্স বাতিল করতে পারেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

এ প্রসঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি তার উত্তর দেন নি।

শাকিল/সাএ