এক দশক আগেও ফিটনেস (জিম) সেন্টারগুলোর প্রতি তরুণ সমাজের আগ্রহ ছিল বেশি। সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমানে প্রায় সব বয়সী মানুষ সুদর্শন শরীর গঠন, সুস্থ থাকা, ওজন কমানো নিয়ে সচেতন হচ্ছে। এ ছাড়া বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। এ জন্য নিয়মিত জিমে উপস্থিত হচ্ছেন তারা। আর এসব কারণে ফিটনেস সেন্টারগুলোও নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আরও আধুনিক হচ্ছে।
সম্প্রতি কথা হয় রাজধানীর বেশ কয়েকটি সিনিয়র ফিটনেস ট্রেইনারের সঙ্গে। তারা বলেন, বর্তমানে সব বয়স ও পেশার মানুষের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করেই আধুনিক হচ্ছে ফিটনেস সেন্টারগুলো। পাশাপাশি ফিটনেস সেন্টারগুলো আধুনিক হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ভালো রাখতে অনুমোদনব্যবস্থা চালু রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
গ্রাহক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে ফিটনেস সেন্টারের সংখ্যাও বেড়েছে জানিয়ে সাবেক মিস্টার বাংলাদেশ ও ফিটনেস পার্ক বিডির সিনিয়র প্রশিক্ষক এ কে রনি রাজ বলেন, ‘রাজধানীতে জিম সেন্টারের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি আধুনিকও হচ্ছে। আগে আমাদের ডাম্বেল ছিল লোহার, এখন সেগুলো রাবার ওয়েট হয়ে গেছে। ৫-৭ বছর আগে জিমে একটা ট্রেডমিল থাকা মানে বিশাল কিছু। এখন মোটামুটি মানের জিমগুলোতেও দু-একটা করে থাকে। আগে ছিল বয়লার স্টিম বাথ, এখন সেগুলো ইলেকট্রিক ইস্টিম বার্থ হয়ে গেছে। এখন সবকিছু আপডেট হয়ে গেছে।
নানা প্রয়োজনেই এখন জিমের প্রতি সবার আগ্রহ বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে বডি বিল্ডআপ করে নিজেকে সুদর্শন রাখা বা নিজের মধ্যে একটা হিরোয়িক ভাব নিয়ে আসার প্রবণতা কাজ করতো। এখন আগ্রহ আরও বেড়েছে নানা কারণে। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই চায় নিজেকে সুঠাম ও সুস্থ রাখতে। এ ছাড়া ওজন কমানো, বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাসহ নানা কারণে এখন সবাই জিমে আসে। তা ছাড়া চিকিৎসকরাও এখন পরামর্শ দেন জিম করার জন্য।’
সময়ের প্রয়োজনে ও ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় ফিটনেস সেন্টারগুলো আধুনিক হচ্ছে জানিয়ে এই প্রশিক্ষক বলেন, ‘রাজধানীতে এখন তেমন মাঠও নেই, যেখানে দৌড়াদৌড়ি করে কিংবা খেলাধুলা করে নিজেকে ফিট রাখবে। সেই কারণেও মানুষ জিম সেন্টার বেছে নিচ্ছে। আর এই চাহিদার কারণে জিম সেন্টারগুলো আধুনিক হচ্ছে। আধুনিক হওয়ার আরেকটা কারণ হলো ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা। কারণ এখন অনেক সেন্টার, তাই সবাই চায় অন্যদের চেয়ে নিজে আরও ভালো সুবিধা দেওয়ার।’
‘জিম সেন্টার চালাতে হলে ভালো করতেই হবে। কেননা মানুষ এখন আরও সচেতন হয়েছে। তারা আধুনিক ইনস্ট্রুমেন্টসহ সুন্দর পরিবেশ চায়। যেখানে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে জিম করবে’, যোগ করেন তিনি।
জিম-ব্যবস্থা আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খরচও বেড়েছে জানিয়ে রনি রাজ বলেন, ’১২ থেকে ১৪ বছর আগেও আমরা জিমে মাসে ২০০ টাকা বেতনে ভর্তি হয়েছিলাম। এখন সেটা সর্বনিম্ন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ হয়েছে। কারণ এখন পরিবেশ সুন্দর হয়েছে, ব্যবস্থাপনা খরচও বেড়েছে।’
ফিটনেস সেন্টারে অংশগ্রহণ বেড়েছে নারীদের
স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ব্যাপারে এখন নারীরাও সচেতন হচ্ছেন। এ কারণে আধুনিক ফিটনেস সেন্টারগুলোয় নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এতে তারাও শরীর গঠনে আগ্রহী হচ্ছেন। কম্বাইন্ড জিমের পাশাপাশি নারীদের জন্য আলাদা জিম সেন্টারও খোলা হচ্ছে। তবে এখনও অধিকাংশ ফিটনেস সেন্টারে পর্যাপ্ত নারী প্রশিক্ষক নিশ্চিত করতে পারছে না।
মিরপুরে জিম করতে আসা রেখা খন্দকার বলেন, ‘একসময় নারীদের জিমের প্রতি আগ্রহ ছিল না, আবার নারীদের জন্য জিমগুলোয় ওই রকম স্বস্তিদায়ক পরিবেশও ছিল না। তবে ধীরে ধীরে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন চিকিৎসকের পরামর্শেও অনেক নারী ওজন কমাতে বা স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করতে জিমে আসেন। ভালো মানের জিমগুলোও নারীদের সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে বেশ সচেতন।’
বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায়ও নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘দেশে এখন নারীদের জন্যও বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ফিট থাকলে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ সচেতন।’
জিম সেন্টারের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে ঝুঁকিও
দেশে জিম সেন্টারের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বেড়েছে প্রশিক্ষকদেরও। তবে বাংলাদেশে একজন প্রশিক্ষক কতটা দক্ষ, তা যাচাই করার জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে দীর্ঘদিন ধরে জিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিই প্রশিক্ষক হিসেবে সমাদৃত হচ্ছেন এবং বিভিন্ন ফিটনেস সেন্টারে প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি নিচ্ছেন। ফলে নানা ভুল প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পিটি একাডেমি থেকে ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক ও জিম নির্দেশকের সনদ পাওয়া এসবিসি জিমের মালিক মো. শাকিল বলেন, ‘আমাদের দেশে জিমে সেন্টার আরও বাড়বে। বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও একসময় জিম বিষয়টা মেডিক্যাল সেক্টরে যুক্ত হবে। তাই আমি মনে করি জিম সেন্টার বা জিমের ট্রেইনার— সবারই একটা প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন ও মান থাকা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে যারা প্রশিক্ষক আছেন, তাদের অধিকাংশ আগের গতানুগতিক ধারায় শিখতে শিখতে প্রশিক্ষক হয়েছেন। আমি ব্যায়াম করছি দীর্ঘদিন। এর থেকে দেখে, ওর থেকে শুনে বা ইউটিউব-গুগল দেখে কিছুটা জানি। কিন্তু আমি কতটুকু জানি, তা একটা প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই করা দরকার। এই ধাপগুলো ঠিকমতো পার করতে পারলে আমি একজন সনদপ্রাপ্ত প্রশিক্ষক হবো। তবে আমার জানামতে দেশে এ রকম সরকারি অনুমোদিত কোনও প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে প্রশিক্ষকদের যোগ্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে সনদ প্রদান করা হয় বা আদর্শ ফিটনেস সেন্টার মাপকাঠি নির্ধারণ করারও কোনও উদ্দেশ্য সরকারের আছে বলে জানা নেই।’
দেশের ফিটনেস সেন্টারগুলোয় আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে অনুমোদিত প্রশিক্ষকের বিকল্প নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষকের একটা ভুল নির্দেশনা স্বাস্থ্যের বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এটা সঙ্গে সঙ্গে বোঝা না গেলেও এই ভুল প্রশিক্ষণের প্রভাব স্বাস্থ্যের ওপর পড়বে ৫ থেকে ১০ বছর পর।’
এ সময় নিয়মিত ব্যায়ামের পাশাপাশি পুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরামর্শে খাদ্য রুটিন করার বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন মো. শাকিল।