ফুলের রাজ্যে তিন দিবসে ৭০ কোটি টাকা বিক্রির আশা

মাঘের শীতে বর্ণিল আভা ছড়িয়ে বসন্তের আগমনী বার্তা দিচ্ছে গদখালীর ফুলের বাগানগুলো। গদখালীর যেকোনো দিকে তাকালেই চোখে পড়ে একটার পর একটা ফুলের বাগান। ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত এটি। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি পয়লা ফাল্গুন, বসন্তের প্রথম দিন। পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এরপর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এসব দিবস সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন ফুল চাষিরা। এই তিন দিবসে ৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন তারা।

এরই মধ্যে গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, টিউলিপ ও লিলিয়াম ফুলের বাড়তি পরিচর্যা করছেন চাষিরা। তাদের আশা, এই মাসের দিবসগুলো ঘিরে ফুলের চাহিদা বাড়বে এবং ভালো দাম পাবেন। 

ফুল চাষিরা বলছেন, এবার এই তিনটি দিবস ঘিরে সারাদেশে দেড় থেকে ২০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে। এর মধ্যে পানিসারা ও গদখালীর ফুল চাষিরা ৬০-৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করবেন।

তবে কৃষি কর্মকর্তরা বলছেন, এই অঞ্চলের চাষিরা চলতি মাসের দিবসগুলোতে ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন। 

ঝিকরগাছার পাটুয়াপাড়া এলাকার ফুল চাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে আজ ২৪ হাজার গাঁদা আর ৩৫০ পিস রজনীগন্ধা এনেছিলাম। গাঁদা এই সময়ে কম দামে বিক্রি হয়। আজ একেক হাজার গাঁদা ফুল ২০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। আশা করছি, বসন্ত আর ভালোবাসা দিবস পর্যন্ত এই ফুলের দাম এমনই থাকবে। কেননা এই সময়ে গাঁদার চাহিদা কম থাকে। তবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে গাঁদা ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। সেসময় একেক হাজার গাঁদা ফুল ৫০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত দাম পাওয়া যাবে।’  

রজনীগন্ধার শ’ ৭০০ টাকায় বিক্রি করেছি জানিয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এবার আমার বাগানে গাঁদা ও রজনীগন্ধা ফুলের ভালো ফলন হয়েছে।’

ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত গদখালী

তিনি বলেন, ‘এখন দাম কম থাকলেও বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসে গোলাপ, জারবেরার দাম বাড়বে। সেক্ষেত্রে গোলাপের পিস ১৫-২০ টাকা এবং জারবেরা ২০-২২ টাকা হতে পারে। এই দুই জাতের ফুলও চাষ করেছি।’

গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জারবেরা ও রজনীগন্ধা মোটামুটি ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন গদখালীর ফুল চাষী ও ব্যবসায়ী রুবেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘চাষিদের ভালো লাভ হচ্ছে। তবে চাষাবাদের খরচ, সার, কীটনাশক, সেচ আর ফুল পরিবহনের ব্যয় বেড়েছে। এগুলোর দাম স্থিতিশীল থাকলে আরও বেশি লাভ হতো চাষি ও ব্যবসায়ীদের।’

ফুল চাষে এখন খরচ বেশ বেড়েছে জানিয়ে নীলকণ্ঠনগর গ্রামের ফুল চাষি আবুল হোসেন খাঁ বলেন, ‘এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতে কৃষকের আয়-ব্যয় প্রায় সমান। বলা যায়, বেঁচে থাকার মতো। ফুল উৎপাদনের জন্য যেসব উপাদান লাগে, সেগুলোর দাম অনেক বেড়েছে। সেই অনুযায়ী ফুলের দাম বাড়েনি। তারপরও আমরা ফেব্রুয়ারি মাসের তিনটি দিবস সামনে রেখে আশায় আছি, বেচাকেনা ভালো হবে। ফুল বেচাকেনা বেশি হলে লাভও তখন বেশি হয়।’

তিন দিবস সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন ফুল চাষিরা

স্থানীয় সূত্র জানায়, ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের চাষিরা সারা বছরই ফুল চাষ করেন। তাদের উৎপাদিত রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল সারা দেশের বিভিন্ন আয়োজনের অনুষঙ্গ হয়।

বিশেষ করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস, খ্রিষ্টীয় নববর্ষ, বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠানে এসব ফুলের বিকল্প নেই। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও রয়েছে এই ফুলের ব্যাপক কদর। তাই এসব দিবসে ফুল বেচাকেনা বেশি হয়।

আড়াই বিঘা জমিতে গ্লাডিওলাস চাষ করেছেন বলে জানালেন গদখালীর চাষি জনাব আলী বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আজ বাজারে ৩৫০ পিস গ্লাডিওলাস এনেছিলাম। সবগুলো বিক্রি হয়েছে। সিঁদুররঙা গ্লাডিওলাস ৮ টাকা দরে এবং ভ্যারাইটি কালারের গ্লাডিওলাস পাঁচ টাকা পিস বিক্রি করেছি। খরচ বাদ দিয়ে মোটামুটি আয় ভালো হচ্ছে।’

তিন দিবসে ৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন চাষিরা

২০২২ সালের আগের দুই বছর ফুলের বাজার একটু খারাপ গেছে জানিয়ে পানিসারা গ্রামের ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছরের শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিজয় দিবস উপলক্ষে বেচাকেনা মোটামুটি ভালো হয়েছে। বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ফুলের বাজার মন্দ যাচ্ছে না বলে যায়। চাহিদা রয়েছে বেশ। চলতি মাসের তিনটি উৎসব ঘিরেই মূলত আমাদের ফুলের বাজার। মাঠে লিলিয়াম রয়েছে, বসন্ত-ভালোবাসা দিবসের আগেই ফুল বাজারজাত করতে পারবো। আশা করছি, প্রতি পিস ৮০ টাকা দরে বিক্রি করা যাবে।’

এবারও টিউলিপ ফুল চাষ করেছি জানিয়ে পানিাসারা গ্রামের ফুল চাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘মূলত শীতপ্রধান দেশের ফুল টিউলিপ। গতবার বীজ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছিলাম, টেকেনি। নেদারল্যান্ডস থেকে এবারও বীজ এনেছি। গত বছর প্রতি পিস ১২০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলাম, এবারও তাই বিক্রি করছি। গতবার আমাকে দেখে এবার আমার মামা শাহজাহান কবীর এবং রঞ্জু নামে আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা টিউলিপ চাষ করেছেন। যদি এবার তারা ভালো ফলন পান, তবে আগামীতে এই ফুলের চাষ বাড়বে।’

তিনি বলেন, ‘টিউলিপ ফুলের চাষ বেশ সহজ। রোপণের ২০-২২ দিনের মধ্যে ফুল ফুটে বিক্রির উপযোগী হয়। দামও ভালো পাওয়া যায়।’

এবার পানিসারা ও গদখালীর ফুল চাষিরা ৬০-৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করবেন

এবার ফুলের বাজার কেমন যাচ্ছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘ফুল পরিচর্যা ও বিক্রির জন্য প্রতিবারের মতো এবারও গদখালী-পানিসারাসহ সারা দেশের চাষিদের প্রস্তুতি রয়েছে। মূলত ফেব্রুয়ারির তিনটি দিবস ঘিরে ফুল উৎপাদন ও পরিচর্যা করেন চাষিরা। তিন দিবসে গদখালী ও পানিসারার চাষিরা ৬০-৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছি। সেইসঙ্গে সারা দেশে এসব দিবসে এবার দেড় থেকে ২০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে।’

সার, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় চাষিরা ফুলের দাম নির্ধারণে হিমশিম খাচ্ছেন জানিয়ে আব্দুর রহিম বলেন, ‘উৎপাদন সামগ্রীর দাম কমিয়ে যদি ফুলের দাম সমন্বয় করা যেতো, তাহলে আরও বেশি লাভবান হতেন চাষিরা।’

দাম স্থিতিশীল থাকলে আরও বেশি লাভ হতো চাষি ও ব্যবসায়ীদের

এ বছর ৬৩০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ। তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফুলের উৎপাদন বেড়েছে। আমাদের আশা, এ বছর এই অঞ্চলে ফুল বিক্রি ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’ 

এ বছর গদখালীতে ফুলের মেলা করার ফলে বিক্রি আরও বেড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘বসন্ত, ভালোবাসা আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা—এই তিন দিবসকে সামনে রেখে এই অঞ্চলের চাষিরা এবার ১০০ কোটি টাকা ফুল বিক্রি করতে পারবেন। কেননা এবারও টিউলিপ আর লিলিয়ামের মতো দামি ফুল ওই সময়ে বাজারে উঠবে। সেইসঙ্গে দাম ভালো পাবেন চাষিরা।’