পোড়াদহে ২শ বছরের পুরনো ‘জামাই মেলায়’ ভিড়, আজ ‘বউ মেলা’

বগুড়ার গাবতলীতে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ ‘সন্ন্যাসী ও জামাই মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজারও মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল মেলায়। কেনাবেচার পাশাপাশি শিশু, কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ নানা বিনোদন উপভোগ করেছেন। মেলায় বিক্রি হয়েছে হরেক প্রজাতির মাছ ও মিষ্টিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে এ মেলার প্রধান আকর্ষণ বাঘাইর মাছ প্রকাশ্যে কেনাবেচা হয়নি। বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) একই স্থানে ‘বউ মেলা’ অনুষ্ঠিত হবে। রীতি অনুযায়ী এদিন মেলায় শুধু নারী ক্রেতা ও বিক্রেতারা অংশ নেবেন।

স্থানীয় প্রবীণরা জানান, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রায় ২০০ বছর ধরে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ী বন্দর সংলগ্ন ইছামতি নদীর তীরে জমিতে সন্ন্যাসী পূজা করে আসছেন। সেকারণে অনেকেই একে সন্ন্যাসী মেলা বলে থাকেন। বাংলা সালের মাঘের শেষ বা ফাল্গুনের প্রথম বুধবার মেলা আয়োজন করা হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ একদিনের মেলায় কেনাকাটা করতে আসেন। লাখ লাখ টাকার মাছ, মিষ্টি, আসবাসপত্রসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বিক্রি হয়ে থাকে।

ঈদ বা পূজায় সম্ভব না হলেও পোড়াদহ মেলার সময় আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করা এখানকার মানুষের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীদের জামাইরা এই সময়টায় তাদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেলাকে উপলক্ষ করে উপস্থিত হন শ্বশুরবাড়িতে। মেলা থেকে বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে ওঠাও এখানকার রীতিতে পরিণত হয়েছে। আর সেকারণেই এই মেলার আরেক নাম পড়েছে ‘জামাই মেলা’।

বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়স ও ধর্ম-বর্ণের হাজারও নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভিড়। এবছর মেলায় বাঘাইর মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি না হলেও বড় বড় চিতল, ভেউস, বোয়াল, রুই, কাতলা, ব্ল্যাক কার্প ও সিলভার কার্পসহ নানা প্রজাতির মাছ বিক্রি হয়। মেলায় আগত দর্শনার্থীদের কারও কাছে মাছের বাজার সস্তা, আবার কারও কাছে চড়া। প্রতি কেজি ভেউস মাছ বিক্রি হয় দেড় হাজার থেকে ২ হাজার টাকায়। মেলায় বোয়াল মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৭০০ থেকে ১৪শ’ টাকা, রুই মাছ ৪০০ থেকে ৯০০ টাকায় এবং কাতলা বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে।

বজলুর রহমান নামে এক ব্যবসায়ী প্রায় ৪০ কেজি ওজনের ব্ল্যাক কার্প মাছ এসেছিলেন। দাম হাঁকছিলেন প্রতি ৮০ হাজার টাকা। পরে একক ক্রেতা না থাকায় মাছটি কেটে বিক্রি করা হয়েছে। মেলায় মাছ ছাড়াও হরেক রকম মিষ্টিও বিক্রি হয়। ১৫ কেজি ওজনের ‘মাছ মিষ্টি’ বিক্রি হয় ৪০০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া কাঠ ও স্টিলের আসবাবপত্র, বড়ই, কৃষি সামগ্রী, মাংস, হরেক রকম আচার ও মিষ্টান্ন বিক্রি হয়েছে। শিশুদের খেলনা ছাড়াও চিত্ত বিনোদনের জন্য বিচিত্রা, সার্কাস, যাদু, নৌকা ও নাগরদোলা ছিল।

পোড়াদহে ২শ বছরের পুরনো ‘জামাই মেলায়’ ভিড়, আজ ‘বউ মেলা’

বাঘাইর মাছ কেনাবেচা নিষিদ্ধ থাকলের মহিষাবান দেব উত্তরপাড়ার মৃত রমজান আলী সাকিদারের ছেলে শুকরা সাকিদার নামে ব্যবসায়ী চারটি বাঘাইর মাছ নিয়ে এসেছিলেন। টের পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফতাবুজ্জামান আল ইমরানের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে আটক ও মাছগুলো জব্দ করেন। পরে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার পর মাছগুলো স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মজিদের জিম্মায় দেওয়া হয়। জব্দ করা মাছের মূল্য দেড় লক্ষাধিক টাকা হবে।

মেলায় আগত গাইবান্ধা সদরের কলেজ ছাত্র রাশেদ সুলতান জানান, তারা প্রতি বছরের মতো এবারও চার-পাঁচ বন্ধু পোড়াদহ মেলায় এসেছেন। দিনভর খাওয়া-দাওয়া শেষে বড় মাছ কিনে বাড়িতে ফিরবেন।

নাটোরের সিংড়া থেকে আগত ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ জানান, তিনি ঈদে সম্ভব না হলেও পোড়াদহ মেলার আগে স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এলাকার শ্বশুরবাড়িতে আসেন। তিনি শ্বশুরবাড়ির জন্য ১৭ কেজি ওজনের বড় সিলভার কার্প মাছ কিনেছেন। 

পোড়াদহে ২শ বছরের পুরনো ‘জামাই মেলায়’ ভিড়, আজ ‘বউ মেলা’

বগুড়া শহর থেকে আসা গণমাধ্যমকর্মী আলমগীর হোসেন জানান, তারা প্রতিবছর পোড়াদহ মেলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। তারা বড় বড় মাছ, মিস্টান্ন, হরেক রকম আচার দেখতে ও খেতে আসেন।

মেলা একদিনের হলেও এর আমেজ থাকে সপ্তাহব্যাপী। মেলাটি জন্মের পর থেকে মহিষাবান গ্রামের মণ্ডল পরিবার পরিচালনা করে আসছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মেলার লাইসেন্স দেওয়া হয়। এবার মেলার নেতৃত্বে ছিলেন মণ্ডল পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় মহিষাবান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ মণ্ডল। স্থানীয় আব্দুল মজিদ মন্ডল জানান, প্রশাসনসহ এলাকাবাসীর সহযোগিতায় শান্তিপূর্ণভাবে মেলা সম্পন্ন হয়েছে। 

পোড়াদহে ২শ বছরের পুরনো ‘জামাই মেলায়’ ভিড়, আজ ‘বউ মেলা’

একই মন্তব্য করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফতাবুজ্জামান-আল-ইমরান। তিনি জানান, ঐতিহ্যবাহী এই মেলা উপলক্ষে ছিল প্রশাসনের কঠোর নজরদারি। 

অন্য দিকে পোড়াদহ মেলা শেষে বৃহম্পতিবার মহিষাবান ও রানিরপাড়া গ্রামে পৃথকভাবে দুটি বউ মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এই মেলায় পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ থাকায় বিভিন্ন বয়সের নারীরা স্বাচ্ছন্দে কেনাকাটা করে থাকেন। প্রায় ২৩ বছর ধরে বউ মেলা হয়ে আসছে। বউ মেলায় একটিতে সার্বিক দায়িত্বে রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম ও অপরটিতে যুবলীগ নেতা সুলতান মাহমুদ মেম্বার।