জুতা পায়ে শহীদ মিনারে আড্ডা চলে খুব, জমে ময়লার স্তূপ

আর মাত্র তিনদিন পরই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এদিন ভাষা আন্দোলনে নিহত শাহীদদের স্মরণ করে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। অথচ শহীদদের সম্মানে নির্মিত শহীদ মিনার রয়েছে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন অবস্থায়। আর জুতা পায়ে শহীদ মিনারের বেদিতে ও সিঁড়িতে বসে আড্ডা দেওয়ার চিত্র তো নিত্যদিনের। মাতৃভাষা দিবস ব্যাতীত এসব দেখারও কেউ নেই।

নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সোনারগাঁ ও বন্দর উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সিঁড়ি ও বেদিতে ময়লা ও ধুলোর আস্তরণ পড়েছে। বাঙালির সম্মান ও চেতনার এই স্থানে জুতা পায়ে উঠে আড্ডা দিচ্ছেন অনেকে। গত কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

শহরের চাষাঢ়া এলাকায় নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবস্থিত। মিনারের চারপাশে বাউন্ডারি ও একাধিক ফটক রয়েছে। তবে সর্বসাধারণের জন্য ফটকগুলো সব সময় খোলা থাকে। ফলে সব সময় দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। যে কারণে মিনার প্রাঙ্গণে চটপটি, ফুচকাসহ নানা ভ্রাম্যমাণ দোকান বসেছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শহীদ মিনারের সিঁড়ি ও বেদিতে জুতা পায়ে অনেক নারী-পুরুষ বসে আড্ডা দিচ্ছেন ও নানা রকমের মুখরোচক খাবার খাচ্ছেন। খাবার শেষে কাগজের টুকরো ও বাদামের খোসা মিনারে ফেলছেন। মিনারের মূল বেদিতে এক পথশিশু ঘুমিয়ে আছে। চটপটি ও ফুচকার দোকানে দর্শনার্থীরা ভিড় করেছে। এসব খাবার দোকানের ফলে পুরো শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া শহীদ মিনারের সিঁড়ি ও বেদিতে ময়লা ও ধুলোর আস্তরণ পড়েছে।

গার্মেন্টকর্মী আজাদ হোসেন বলেন, ‘শহীদ মিনারে আমি একা জুতা পায়ে উঠিনি। সবাই উঠেছে। তা দেখে আমিও উঠে বসেছি। তাছাড়া আমি শহীদ মিনারের সিঁড়িতে বসেছি, উপরে উঠিনি।’

কলেজ শেষে বন্ধুদের নিয়ে শহীদ মিনারে ঘুরতে আসেন সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী শান্তা আক্তার। তার ভাষ্য, ‘প্রতিদিন শহীদ মিনারে জুতা পায়ে দর্শনার্থীদের বসে থাকতে দেখি। এটা নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। তাছাড়া কাগজসহ খাবারের নানা উচ্ছিষ্ট দিয়ে পুরো মিনার প্রাঙ্গণ নোংরা করে রাখে। এমন নোংরা সারা বছর থাকে। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারির আগে পরিষ্কার করে ফুল দেওয়া হয়।’

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শহীদ মিনার নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। তবে বিভিন্ন সংগঠন শহীদ মিনারে নানা অনুষ্ঠান করে থাকে। এতে করে শহীদ মিনার অপরিষ্কার হয়ে যায়। তারপরও আমরা বিষয়টি দেখবো।’

শহীদ মিনারে জুতা নিয়ে অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিয়ম মানানোর জন্য লোক দেওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতন হওয়া দরকার।’

জুতা পায়ে শহীদ মিনারে আড্ডা চলে খুব, জমে ময়লার স্তূপ

সোনারগাঁয়ের উপজেলা চত্বরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও দেখা গেছে একই চিত্র। জুতা পায়ে অনেক নারী-পুরুষ শহীদ মিনারে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। আশেপাশের কোনও এক বই ব্যবসায়ী সারি সারি বইয়ের বান্ডেল রেখে মিনারের সিঁড়িতে ভাঁজ করছেন। আর গাছের শুকনো পাতায় পুরো শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ নোংরা হয়ে আছে।’

সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রেজওয়ান-উল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেক শিক্ষিত লোক ও শিক্ষার্থী জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠে যায়। আমি বেশ কয়েকদিন এদের ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। জুতা পায়ে উঠার জন্য ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে গেছে। এ বিষয়ে সাইনবোর্ড ঝুলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে কমন সেন্সের অভাবে তারা জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠছে।’

শহীদ মিনারে ময়লার বিষয়ে তার ভাষ্য, ‘সকালে নিয়মিত শহীদ মিনার পরিষ্কার করা হয়। বিকালে গাছের পাতা পড়ে থাকে। সেটা হয়তো আপনার চোখে পড়েছে। বন্দর উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ফটক দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হয়। যে কারণে বেশ শৃঙ্খলা দেখা গেছে। তবে গাছের শুকনো পাতা পড়ে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ নোংরা হয়েছে, মিনারের সিঁড়ি ও বেদিতে ময়লার আস্তরণ জমেছে।’

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, জুতা পায়ে একদল শিক্ষার্থী শহীদ মিনারের সিঁড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ছবি ও সেলফি সময় কাটাচ্ছে। এ সময় শহীদ মিনারের ছবি তুলতে গেলে কয়েকজন শিক্ষার্থী এসে বাধা দেয় ও ছবি ডিলেট করতে বলে। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে শিক্ষার্থীরা তড়িঘড়ি করে চলে যায়।

জুতা পায়ে শহীদ মিনারে আড্ডা চলে খুব, জমে ময়লার স্তূপ

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্দর উপজেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চারপাশে বাউন্ডারি দেওয়া রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শহীদ মিনারের ফটক খোলা হয়। যাতে করে স্কুল-কলেজের সময়ে শিক্ষার্থীরা এসে আড্ডা দিতে না পারে। ভোর থেকে শুরু করে সকাল ১০টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শহীদ মিনারে প্রবেশের ফটক খোলা রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বখাটে ছেলেরা যাতে আড্ডা দিতে না পারে সে জন্য নির্দিষ্ট সময়ে শহীদ মিনারে প্রবেশের ফটক খোলা হয়।

বন্দর উপজেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি দেখভাল করে আসছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নামে একটি ক্লাবের নেতারা। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিএম মাসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পানির সংকটের কারণে শহীদ মিনার নিয়মিত ধোঁয়া-মোছা সম্ভব হয় না। তবে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। প্রতিদিন সকালে ঝাড়ু দেওয়া হয়।’

জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠার বিষয়ে জানতে চাইলে তার বক্তব্য, ‘এটা নিষেধ করা হয়েছিল। সাধারণত সবাই জুতা খুলে শহীদ মিনারে উঠে। তবে জুতা পায়ে কেউ শহীদ মিনারে উঠলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে দেই। আমাদের চোখে পড়লে কাউকে জুতা পায়ে উঠতে দেই না। তারপরও হয়তো অনেকে আমাদের চোখ এড়িয়ে অনেকে জুতা পায়ে উঠে যায়। এটা ঠিক না।’

অসচেতন ব্যক্তি জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠছে উল্লেখ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জেলার সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সহ সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল। তিনি বলেন, ‘একদল অসচেতন ব্যক্তি জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠছে। কাগজসহ নানা বস্তু ফেলে শহীদ মিনার অপরিষ্কার করছে। এটা সচেতনতার অভাব থেকে হচ্ছে। শহীদ মিনার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আমরা চেষ্টা করেছিলাম। এর পবিত্রতা নষ্ট করা থেকে শুরু করে অনাকাঙ্খিত মাদক ব্যবসা পর্যন্ত হচ্ছে। এসব প্রতিরোধে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য আমরা সিটি করপোরেশনের কাছে দাবি জানিয়েছিলম। কিন্তু লাভ হয়নি।’

জুতা পায়ে শহীদ মিনারে আড্ডা চলে খুব, জমে ময়লার স্তূপ

সমস্যা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ভবানী শংকর রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শহীদ মিনারে জুতা পায়ে উঠার চিত্র অহরহ দেখা যায়। এটা খুবই দুঃখজনক। চাষাঢ়া শহীদ মিনার এখন বাজারে পরিণত হয়েছে, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ জুতা পায়ে উঠে আড্ডা দিচ্ছে। যথাযথ শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে তারা এটা করছে। এ কারণে আমরা শহীদ মিনারে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছিলাম। বিভিন্ন ব্যক্তিকে অনুরোধ করেছি জুতা পায়ে শহীদ মিনারে না উঠতে। এটা আসলে একজন দুজনকে বলে হবে না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

রাজনৈতিক নেতারা শহীদ মিনারের পবিত্রতা নষ্ট করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেক রাজনৈতিক নেতাও বক্তব্য দেওয়ার সময় জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠে যায়। এরা শুধু মুখে মুখে দেশপ্রেম ও ভাষা আন্দোলনের কথা বলে। দেশত্ববোধ ও ভাষা আন্দোলনের প্রতি এদের শ্রদ্ধা নেই বলেই কাজগুলো করেছে। এটা রীতিমত অপরাধ।’

উল্লেখ্য, শহীদ মিনারে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশ আয়োজন করা হয়। গত ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শহরের চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণতন্ত্র মঞ্চের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না জুতা পায়ে শহীদ মিনারের সিঁড়িতে উঠে বক্তব্য দিয়েছেন। সেই ছবি ও ভিডিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ফলে তিনি বেশ সমালোচিত হন। এছাড়াও জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নানা কর্মসূচিতে নেতাদের প্রায় সময় জুতা পায়ে শহীদ মিনারে উঠতে দেখা গেছে। সেই সংবাদ বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।