বিশ্বসাহিত্যের  মিলান কুন্দেরা

বিশ শতকের অন্যতম পাঠকপ্রিয় লেখক মিলান কুন্দেরার জন্ম চেকোস্লোভাকিয়ায়। তবে তাকে আমরা ফরাসি লেখক হিসেবে চিনি। তার বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’, ‘দ্য জোক’, ও ‘দ্য বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং’। নিজ দেশে কমিউনিস্ট দুঃশাসনের সময় তাঁর বইপত্র দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল।

১৯২৯ সালের ১ এপ্রিল চেকোস্লোভাকিয়ার ব্রুনো শহরে এক বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মিলান। তার বাবা লুদ্ভিক কুন্দেরা বিখ্যাত সংগীততাত্ত্বিক ছিলেন। বাবার সংগীতের প্রতি টান শিশু মিলানের মধ্যেও ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয় এবং পরে তিনি সংগীতবিদ্যার পাঠ নেন। সংগীত তার লেখালেখিতেও প্রভাব বিস্তার করেছে। কম বয়সে কুন্দেরা চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অনুরক্ত হন এবং সমর্থক হিসেবে নাম লেখান।

ব্রুনোর একটি স্থানীয় স্কুলে পড়ালেখা শেষে তিনি প্রাগে পাড়ি জমান। প্রাগের চার্লস ইউনিভার্সিটিতে সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্বে পড়ালেখা করেন। পরে প্রাগের ‘ফিল্ম ফ্যাকাল্টি অব দ্য পারফর্মিং আর্টস’-এ তিনি ফিল্ম ও স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের ওপর কোর্স করেন। এ প্রতিষ্ঠানেই তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন বিশ্বসাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৬ সালে তিনি পুনরায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং চার বছর পর বহিস্কৃত হন।

কুন্দেরার প্রথম জীবনের লেখালেখিকে অনেকে তীব্রভাবে কমিউনিস্টপন্থী হিসেবে বিবেচনা করেন। ১৯৫০-এর দশকে তিনি নাটক এবং প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি অনুবাদও করেন। এসময় তার বেশকিছু কবিতা প্রকাশিত হলেও ছোটোগল্পের সংকলন ‘Laughable Loves’-এর জন্য প্রসংশিত হন। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করেছেন।

পরবর্তীকালে কুন্দেরা রাজনৈতিক মতামত এড়িয়ে দার্শনিকতার দিকে মনোযোগী হন। লেখালেখির কৌশলগত দিক থেকে তিনি রবার্ট মিউসিলের উপন্যাস এবং দার্শনিকতার দিক থেকে ফ্রেডরিখ নিৎসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে করা হয়। এছাড়াও ফ্রানৎস কাফকা, মার্টিন হাইডেগার, সার্ভেন্তিস ও বোকাচিও দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত।

কুন্দেরা শুরুতে চেক ভাষায় উপন্যাস লিখেছেন। পরে ফ্রান্সে স্থায়ী হওয়ার পর ফরাসিতে লেখালেখি করেন। ১৯৮০ দশক জুড়ে তিনি তার চেক ভাষায় লেখাগুলোকে ফরাসিতে অনুবাদের উদ্যোগ নেন। এরপর থেকে তিনি নিজেকে একজন ফরাসি লেখক হিসেবেই পরিচয় দিতেন।

‘দ্য জোক’ বাংলায় যাকে ‘ঠাট্টা’ হিসেবে অনুবাদ করেছেন শেখ আবদুল রহমান ১৯৭২ সালে। ‘দ্য জোক’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে এবং এটাই তার প্রথম উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। কমিউনিস্ট শাসনের ‘টোটালিটারিয়ান’ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ‘স্টালিনিজম’ এ বইয়ের মূল বিষয়। সোভিয়েত আক্রমণকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করার কারণে চেকোস্লোভাকিয়ায় ১৯৭৩ সালে তার লেখা নিষিদ্ধ করা হয়। ‘ঠাট্টা’ উপন্যাসের নায়ক লুদ্ভিকের ঠাট্টা যে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে এত ভয়ানক আঘাত হিসেবে দেখা দেবে সেটা শুরুর দিকে যেকোনো পাঠকও আন্দাজ করতে অক্ষম।

কুন্দেরার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘লাইফ ইজ এলসহয়্যার’ বা ‘জীবন অন্য কোথাও’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একজন আদর্শবাদী কবির রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যাওয়ার গল্প।

রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত বিষয়ে লেখালেখি ছেড়ে কুন্দেরা এবার মনোযোগী হন দর্শনভিত্তিক লেখালেখিতে। ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বইটি ছাপা হয় ১৯৮৪ সালে। দর্শনের আগ্রহী পাঠকমাত্রই এই উপন্যাস পড়ে নিজের মধ্যে একটা নাড়া অনুভব করবেন।

আজকের বিশ্বসাহিত্যে কুন্দেরা একটি স্থায়ী নাম। মূলত দুইটি কারণে তিনি বিখ্যাত। তার লেখায় আছে দর্শনের নিবিড় উপস্থাপনা, অন্যদিকে আছে রাজনৈতিক বিদ্রুপ বা ঠাট্টা যা বর্তমান যুগের অধিকাংশ সংবেদনশীল মানুষের মনের খোরাক। তার বিখ্যাত উক্তি ‘Optimism is the opium of the people’ যা নৈরাশ্যবাদী দার্শনিক শোপেনহাওয়ারকে প্রতিধ্বনিত করে। রাষ্ট্রযন্ত্র ঠাট্টা বা সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। সে বিষয়ে ইঙ্গিত করে কুন্দেরা বলেছেন, ‘ক্ষমতার সঙ্গে ব্যক্তির লড়াই মূলত ভুলে যাওয়ার বিপরীতে মনে রাখা’।

বিশ শতকের অন্যতম এই লেখকের সঙ্গে সবচেয়ে বড় ঠাট্টা করেছে বোধহয় নোবেল কমিটি। বারবার মনোনীত হওয়ার পরেও তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত না করা আলফ্রেড নোবেলের লিখে যাওয়া উইলের সঙ্গে অনেকটা ঠাট্টার সামিল। পাঠকের মনে বিস্তর প্রভাব বিস্তারকারী রাশিয়ান গ্রেট তলস্তয়, নরওয়ের বিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের সঙ্গে কুন্দেরার নামটাও একযোগে উচ্চারিত হয় এই কারণেই।