Independence Day 2023: ভাঙুক নারী-পুরুষের ‘বাইনারি’ সংজ্ঞা, স্বাধীন হোক শরীর! উচ্চমাধ্যমিকের কৃতি শরণ্যার এটুকু স্বপ্ন

 মন ও শরীরের সুর-তাল

লুকোচুরি, ছোঁয়াছুঁয়ির মতো খেলাই বেশি প্রিয় পাঁচ ছয় বছরের শরণ্যর। খেলার সঙ্গী হিসেবে ছেলে নয়, বেশি পছন্দ ছিল মেয়েরাই। প্রথম প্রথম সব স্বাভাবিক থাকলেও পরের দিকে ব‌্যাপারটা বন্ধুদের ‘চোখে লাগতে থাকে’। খেলার সময় শরণ্যকে প্রায়ই শুনতে হত, ‘তুই এমন মেয়েদের মতো করিস কেন?’ কথাটা শুনে মনে ধাক্কা লাগত। ব্যাপারটাকে খুব আমল না দিলেও একেবারেই যে ভাবনার বাইরে থাকত তা নয়। মেধাবী ছেলেটা পড়ার মধ্যে একটু ফাঁক পেলে ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও ভাবত।

প্রাইমারি স্কুল থেকেই শরণ্য এমন। এমন মানে এমন। ছেলের মতো দেখতে হলেই যে এই এই কাজ করতে হবে, তা যে কোথাও লেখা নেই। তাই মনের মতো করেই নিজেকে মেলে ধরতে বিশ্বাসী ছিল সে। ধীরে ধীরে প্রাইমারির গণ্ডি পেরোল সে। নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগাগুলো দেখে মনের খাতকে চিনতে লাগল বয়েজ স্কুলের ছেলেটা। একটা বোধ তৈরি হতে থাকল, মন যে খাতে বইতে চায়, শরীর সে খাত চেনেই না। শরীরের রূপরেখা মনের পছন্দ অপছন্দ না দেখেই যেন কেউ এঁকে রেখে গিয়েছে। মন আর শরীরের সুর-তালটা যেন অনেকটাই আলাদা। আলাদা বলে গানটাও ঠিক সুন্দর হয়ে উঠছে না শরণ্যর কাছে।

বাঁকা চোখের আঙ্গিকে

বয়েজ স্কুলে পড়তে হচ্ছে বলে তেমন অস্বস্তি হয়নি শরণ্যর। তবে ছেলেদের সঙ্গে ওঠা বসা করলেও মন যে অন্য কথা বলত, সে খেয়ালও ছিল। কিন্তু বয়েজ স্কুলে পড়ার একটা যন্ত্রণা তাঁকে ভুগতে হয়েছে। ‘মেয়েলি’ হাবভাবের জন্য কোনও কোনও সহপাঠী তাঁকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। আমল দেয়নি শরণ্য। মনের উপর ওই হালকা চোট নিয়েই দিব্যি পড়াশোনা চালিয়েছে। কারণ পড়াশোনা করেই একমাত্র জিতে নেওয়া যায় সবটা, এ বিশ্বাস ছোট থেকেই গাঁথা ছিল মনে। 

তবে সময় যত যায়, এক দিকে শরীরের বক্তব্য প্রবল হতে থাকে, অন্য দিকে পরিনত হত থাকে মন‌ও। তাই ক্লাস টেনে ওঠার পরই বাড়িতে জানিয়ে দেয় মনের বয়ান। বাবা-মা যদিও আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিল। ইতিমধ্যে স্কুলেও নিজের বন্ধুদের জানিয়েছিল সে।  বন্ধুদের তরফে যথেষ্ট সমর্থন ছিল তার জীবনের এই অভিমুখ নিয়ে। 

পরিবার থেকে যখন মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, তখনও নিজের পছন্দ অপছন্দের কথাই খুলে বলে সে। জানায়, মন যেভাবে কথা বলতে চায়, শরীর সেভাবে বলে না। এর পরই শরণ্য হয়ে ওঠে শরণ্যা। শরণ্যা ঘোষ। এবার প্রধান শিক্ষকের কাছেও গেল পরিবার। আর শার্ট প্যান্ট নয়, সালোয়ার কামিজ পরেই স্কুলে আসতে চায় সে। প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে যখন প্রথম সালোয়ার কামিজে স্কুল ঢুকল শরণ্যা, অনেকেই তাকিয়েছিল বাঁকা চোখে। কিন্তু ততদিনে আসল লড়াইটা যে লড়া হয়ে গিয়েছে। তাই সেদিন সব তির্যক চাহনি পেরিয়ে আলাদা মুক্তির স্বাদ উপভোগ করল সতেরোর কিশোরী।

মনের স্বাধীনতা

ক্লাস ইলেভেনে তাঁর লিঙ্গপরিচয় নিয়ে খুব সমস্যায় পড়তে হয়নি স্কুলে। বরং তিনি নিজে যাতে বিশ্বাস করত, সেভাবেই নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছে। বন্ধুরাও সায় দিয়েছে তাঁর লিঙ্গসম্পর্কিত সিদ্ধান্তে। শরণ্যা বড় হয়ে ডব্লুবিসিএস অফিসার হতে চান। আবার অধ্যাপনার দিকেও বেশ ঝোঁক রয়েছে‌। ২০২৩ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সপ্তম স্থান অর্জন করেছেন শরণ্য থেকে শরণ্যা হয়ে ওঠা তরুণীটি। আপাতত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ছেন জনাই ট্রেনিং হাই স্কুলের কৃতি ছাত্রী। ফোনের কথালাপে শরণ্যা বলছিলেন, ‘বড় হয়ে যা-ই হই, সমাজের এই বেঁধে দেওয়া চিন্তাভাবনাগুলোকে পাল্টানোর চেষ্টা করব। আমারও কিছু সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। সেগুলোই করে যাওয়ার চেষ্টা করব।’ মনের স্বাধীনতাই যে আসল স্বাধীনতা সে কথাও বললেন আঠারোর সদ্য যৌবনা। তাঁর কথাগুলো শুনতে শুনতে ফোনের এপারের শ্রোতার মনে হচ্ছিল —  সত্যিই তো! মনই তো মানুষকে তাবৎ প্রাণীজগতের মধ্যে বিশেষ করে তুলেছে। মন-মস্তিষ্কের গভীর আলাপ যখন শরীরী আদল ছাপিয়ে যায় তখনই তো মানুষ আদতে মানুষ! স্বাধীন!