টাকা পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই মালয়েশিয়া, পথে পথে নির্যাতন-মুক্তিপণ

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বিশনন্দী গ্রামের জহিরুল ইসলাম। ওই এলাকায় সাইন পেন্টিং নামে জহিরুল ও তার বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ প্রেসের ব্যবসা করতেন। ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই চলছিল জহিরুলের সংসার। এরই মধ্যে জহিরুলের পরিচয় হয় মানবপাচার সিন্ডিকেটের এক সদস্যের সঙ্গে। চক্রের সদস্যরা কোনও টাকা ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভন দেখায়।

জহিরুলকে বলা হয়, মালয়েশিয়া যাওয়ার পর কাজ করে তাদের ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেই হবে। বড় ভাই আবুল কালামকে না জানিয়েই জহিরুল এই ফাঁদে পা দেন। পরে চলতি বছরের মার্চ মাসে নিখোঁজ হন। প্রায় এক মাস পর পরিবারের লোকজন জহিরুলের সন্ধান পায়।

একদিন জহিরুল তার পরিবারকে ফোন করে জানায়, তাকে মিয়ানমারে আটকে রেখেছে মানবপাচারকারীরা। মুক্তিপণ চেয়ে তার ওপর চালাচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। এ জন্য বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে বলে। নিরুপায় হয়ে দালালদের কথামতো দফায় দফায় কয়েক লাখ টাকা পাঠান জহিরুলের ভাই আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু টাকা পাঠানোর পরও স্বজনকে আর ফেরত পায়নি পরিবার। নির্যাতনের পর তাকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে মালয়েশিয়া পুলিশ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। গত ২৪ মে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদকের কাছে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দেন ভুক্তভোগী জহিরুলের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ।

জানা গেছে, শুধু জহিরুলই নন, এই আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের খপ্পরে পড়েন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের আরও ২১ তরুণ। তারা গত ১৯ মার্চ সেখান থেকে বাসে টেকনাফ যান। পরে তাদের নৌপথে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানমারে। মূলত চক্রটি সেখানেই সবাইকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করতো। যেসব ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিতো, তাদের মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলে নামে এক দালালের কাছে পাঠিয়ে দিতো। ওই রশিদুল প্রায় ২৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। প্রায় ২০ বছর ধরে মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত সে।

আড়াইহাজার থেকে যাওয়া ২২ জনের মধ্যে ১৯ যুবককে তাদের ক্যাম্পে নেওয়ার আগেই মিয়ানমারের কোস্টগার্ডের কাছে আটক হয়। আর বাকি তিন জনকে কৌশলে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে যায় চক্রটি। মিয়ানমারের নাগরিক জামাল তার ক্যাম্পে তিন জনকে আটকে রেখে নির্যাতন করে। সেই নির্যাতনের চিত্র ভিডিও করে গ্রেফতার ইসমাইলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে। এই তিনজনের একজন ছিলেন জহিরুল ইসলাম, যিনি মালয়েশিয়ায় মারা যান।

র‍্যাব বলছে, মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হচ্ছে মালয়েশিয়া যাওয়ার একটি নতুন রুট। মানবপাচার চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর দেশে এই চক্রের আরও ১০ থেকে ১৩ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। তাদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে র‍্যাব।

ভুক্তভোগী জহিরুলের ভাই আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার ভাই নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর আড়াইহাজার থানায় একটি জিডি করি। এর ১০ দিন পর আমি জানতে পারি আমার ভাইকে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য।

তিনি আরও বলেন, গত ১৪ এপ্রিল এলাহী, জসিম আবুল নামে তিনজন লোক আসে আমার কাছে। তারা আমাকে আমার ভাইয়ের জন্য ১৮ লাখ টাকা দিতে বলে। আমি তাদের বলেছি, আমি টাকা দেবো। তবে আমার ভাইকে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। আমার ভাই আমার সঙ্গে ব্যবসা করে। ভাইকে ছাড়া আমি একা ব্যবসা করতে পারবো না। তারা তখন বলে, লোক ফেরত দেওয়া হবে না। মালয়েশিয়ায় ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। পরে তারা বলে, টাকার কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। কিন্তু টাকা দিয়ে দিতাম।

আবুল কালাম বলেন, এ বিষয়ে থানার ওসির সঙ্গে পরামর্শ করি। ওসি আমাকে বলেন, লোকগুলো যখন টাকা নিতে আসবে, এ সময় যেন ওসিকে আমি জানাই। তার কথামতো পরের দিন লোকেরা টাকা নিতে এলে ওসিকে জানাই। ওসি ফোর্স নিয়ে এসে আবুলকে গ্রেফতার করেন। বাকি দুজন এলাহী ও জসিম পালিয়ে যায়। একজন গ্রেফতার হওয়ার পর মামলা করা হয়। এ ঘটনার চার দিন পর চক্রের সদস্য জসিম ও আরও কয়েকজন আমাকে লোক মারফত জানায়, আমি যে মামলা করছি, এ কারণে টাকা দিলেও আমার ভাইকে আর ফেরত পাবো না।

তিনি আরও বলেন, মামলা করার পর তারা আমার ভাইকে আরও বেশি নির্যাতন ও মারধর করে। চক্রটি তারপরও আমাকে চার লাখ টাক দিতে বলে। পরে তাদের কথামতো প্রথমে আমি ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাই। তারপর বিকাশেও কিছু টাকা পাঠাই। এ টাকা পাঠিয়েছি যেন আমার ভাইকে নির্যাত না করে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু আমার ভাই শেষে মারা যায়। তার মরদেহ দেশে আনতে আরও ৩ লাখ টাকা খরচ হয়।

অশ্রুভেজা চোখে আকুতি জানিয়ে আবুল কালাম বলেন, আমার ভাইয়ের মতো ভিসাবিহীন আর কেউ যেন এভাবে বিদেশ না যায়। তাহলে আমার মায়ের মতো অনেক মায়ের বুক খালি হবে। আমি এর বিচার চাই এবং জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।

এদিকে গত ১৮ আগস্ট রাতে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। তারা হলো মো. ইসমাইল, জসিম ও মো. এলাহী।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্য শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার ইসমাইল ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ছিল। সেখানেই তার পরিচয় হয়েছে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের বাসিন্দা (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সঙ্গে। একপর্যায়ে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। পরে ইসমাইল দেশে ফিরে এলেও রশিদুল ও জামালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। রশিদুল ও জামালের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জনের এই আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র গড়ে ওঠে। সেই চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে বাংলাদেশে।

তিনি আরও বলেন, চক্রটি এলাকার তরুণ ও যুবকদের টার্গেট করতো। একটি উন্নত জীবনের এবং ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কোনও অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভন দেখাতো। তারা বলতো, সেই দেশে যাওয়ার পর কাজ করে তাদের ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেই হবে। আর এই প্রলোভনে পড়ে ইতোমধ্যে নিঃস্ব হয়েছে অনেক তরুণ। এ চক্রের ফাঁদে পড়েই প্রাণ গেছে আড়াইহাজারের বিশনন্দী গ্রামের জহিরুলের।

তিনি বলেন, ভুক্তভোগী জহিরুলকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া (জোহার বারুত) পাঠানো হয়। নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি (জহিরুল) মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তি হন। গত ২৪ মে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুসনদে কারণ হিসেবে তার শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে।

২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার লাশ দেশে আনা হয়। বাকি দুজন এখন মালয়েশিয়ায় আছেন। আর মিয়ানমার কোস্টগার্ডের হাতে আটক ১৯ জন দেশটির কারাগারে আটক আছেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের কার্যক্রম চলমান বলেও জানান র‍্যাবের মুখপাত্র।

তিনি আরও বলেন, চক্রটি প্রথমে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহীদের বাসে করে কক্সবাজার টেকনাফের মানবপাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের কাছে হস্তান্তর করে। আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে ট্রলারে করে মিয়ানমারে অবস্থানরত জামালের কাছে পাঠিয়ে দেয়। জামালের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার দিকে রওনা হয়।

খন্দকার আল মঈন বলেন, ভুক্তভোগীদের মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ার নির্জন একটি জায়গায় নিয়ে রাখা হতো। যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পৌঁছাতে পারে না। এমন আরও অনেকে তাদের হাতে নির্যাতিত হয়ে মালয়েশিয়া রয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে তাদের পরিবার থেকে কোনও অভিযোগ না আসায় আমরা তাদের পরিচয় এখনও জানতে পারিনি।