মমতা শঙ্করের কথার প্রতিবাদ হবে বুঁকের খাঁজ দেখিয়ে, ভয়ঙ্কর! এ সমাজের পরিণতি কী

অর্যমা দাস, ক্যালগেরি, কানাডা

সম্প্রতি কলকাতার এক পরিচিত সংবাদমাধ্যমে শিল্পী মমতা শঙ্কর বলেন, ‘আজকাল যেমন হয়েছে যে শাড়ি পরব কিন্তু আমার আঁচলটা ঠিকমতো থাকবে না। আগে আমরা যেরকম বলতাম রাস্তার মেয়ে (ক্ষমা করবেন বলছি বলে)। যাঁরা ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে থাকে বলতাম, তাঁরা ওরকম ভাবে দাঁড়াত। তাঁরা তাঁদের পেশার জন্য এমনটা করছেন।’ তাতে সোশ্যাল মিডিয়া গর্জে উঠেছে নানা ভাবে। তার মধ্যেই একটা প্রতিবাদ আমার চোখ টানল। অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের ফেসবুক পোস্ট, সেখানে একজন আর্টিস্টের সুন্দর একটা পেনসিল স্কেচ, ক্যাপশনে লেখা, ‘আমিও এইরকম একটা ছবি তুলব। ল্যামপোস্ট এর নিচে দাঁড়ানো খারাপ মেয়েগুলোকে উৎসর্গ করে। শাড়ির আঁচলেই কি না সব সম্মান লুকিয়ে আছে যদি ওরা জানতো। আমার বন্ধু ফোটোগ্রাফাররা একটু হাত খালি হলে জানিও।’ আমি বুঝলাম, আচ্ছা প্রতিবাদ হবে তবে এইবার শাড়ির আঁচল সরিয়ে বুঁকের খাঁজ দেখিয়ে। ভীষণ ভয় করল।

জানেন তো? মিডিয়াই হল সমাজের সবচেয়ে বড় আয়না। ঠিক যেমনটা বুককাটা বা পিঠকাটা ব্লাউজ পরে নায়িকাকে লাস্যময়ী লাগে, আমি সেই রকম আকর্ষণীয় হব বলে ইচ্ছা জাগে মনে। এখন সেই মিডিয়া যখন টেলিভিশন ছেড়ে সোশ্যাল মিডিয়া হল, সবাই তখন সমাজের কাছে নায়িকা হয়ে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন, সেই মিডিয়াতে যেমন আমার বুকের খাঁজ দেখে আকর্ষিত হয়ে বাহবা দেওয়ার লোকজন থাকে, তেমনই থাকে আমার বাবা-মা, শশুরবাড়ি, আত্মীয়, শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রতিবেশী বা গুরুজনেরা। আমরা আজকাল তাদেরকেও তোয়াক্কা কম করে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার প্রচেষ্টায় মেতেছি। তাঁদের সামনেও উন্মুক্ত হতে লজ্জা করে না আর। মানে আমার চারদেওয়ার ভিতর আর বাইরের পার্থক্যটা খুবই কম এখন। আগে এই নায়িকা আর সমাজের সাধারণ মেয়েদের একটা পার্থক্য ছিল। বোকাবাক্সটার ভিতর আর বাইরেটা। আজ ডিজিটাল মিডিয়াতে সত্যিই আর কোনও বিভেদ নেই। ‘দৃষ্টিকটূ’ শব্দটার সমাজে আর খুব একটা মূল্য নেই।

আমার প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গে এমন তো বহু মানুষ রয়েছেন যাঁরা মমতা শঙ্করের কথা টেনেই বলি তথাকথিত ‘আমার আঁচলটা ঠিকমতো থাকবে’ এমনভাবেই শাড়ি পরে সমাজের অনেক উচ্চপদে কর্মরত। আচ্ছা সাধারণের কথায় আসি, আমাদের মা-কাকিমাদের তো দেখিনি কখনও বক্ষবিভাজিকা দেখিয়ে শাড়ি পরতে। আমাদের জেনেরেশনেও বহু মেয়েকে দেখেছি আঁচল ঢেকেই শাড়ি পরেন। আমি তো জানতাম আঁচলের কাজটাই এটা। তাহলে তারা কি তবে আজ ভুল? যাঁরা বুক দেখিয়ে আকর্ষিত হওয়ার কথা ভাবেন না, সেই গোষ্ঠীর কী অপরাধ? এ কোন সমাজ, যাঁরা বুকের খাঁজ দেখানোর জন্য তীব্র লড়াইয়ে নামল আজ? কী কী দেখতে হবে তবে? আমরা কোন জেনরেশন, যাঁরা এই স্বাভাবিকভাবেই পুরনো সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে এগিয়ে চলা এক মানুষকে একটা বক্তব্যের জন্য আজ নীতিপুলিশি করছি? আগের দিন অবধি কিন্তু তাঁর আর্টকে শ্রদ্ধা করতাম, তাঁকেও শ্রদ্ধা করতাম। আজ তাঁকে অন্য রকমের মানুষ লাগছে কেন? তাঁর দৃষ্টিকটূ লাগে, তাই তিনি বলেছেন। কেন সেই কথার প্রতিবাদ করতে হবে আমাদের?

আমি প্রবাসী বাঙালি। কানাডায় থাকি। ক্যালগেরি শহরটা অদ্ভুত, শীতপ্রধাণ এই দেশে মাত্র চারমাস গরমকাল। বাকি সময় বরফ, তাই শুধু চোখ-নাক ছাড়া পুরো ঢেকে বেরতে হয়। গরমকাল এলেই এখানে মেয়েরা বিকিনি আর ছেলেরা ছোট একটা প্যান্ট (আমাদের জাঙ্গিয়া বা অন্তর্বাসের মতো দেখতে অনেকটা) পরেন, গা খালি। সেই পোশাক পরেই পাহাড় চড়া, কায়াকিং, বোটিং, সাইক্লিং, স্কেটিং, রাস্তায় সাধারণ হেঁটে চলা সব কিছুই করেন। কিন্তু তাঁদের তা নিয়ে কোনও আড়ষ্ঠতা নেই, কোনও সংশয় নেই, কোনও অস্বস্তি নেই। সবচেয়ে বড় কথা কোনও ছেলে তো দূর, কোনও মেয়েও তাকিয়ে দেখে না তাঁদের দিকে। অদ্ভুত ব্যপার এদেশে ইভটিজিং বা ধর্ষণের ঘটনা হয় না বললেই চলে। আমারও ইচ্ছে হল, আমিও এইখানে এসে শর্টস, খোলামেলা পোশাক পরতে শুরু করলাম তাঁদের দেখে। আসলে বেমানান লাগছিল কেমন ঠিক, তবে এমনটা নয় শাড়ি ছেড়ে দিলাম। তবে রোজকার জীনবযাপনে শাড়িটা সত্যিই পরা হয়ে উঠছে না, পুজো-পার্বন বা কোনও ভারতীয় বাড়িতে নিমন্ত্রণে শাড়ি পরছি। গরমকালে কানাডাতে সবজিবাজার করতে কিন্তু শর্টস পরে যেতেই পারি। তবে কলকাতাতে কী আমি কোনও দিন শর্টস পরে সবজি কিনতে যাব বাজারে? তাতে অসুবিধাটা কোথায় তবে? আমি কি ধর্ষণ হয়ে যাব ভেবে পরব না সেটা? না। আমার শালিনতা বাঁধা দিচ্ছে সেই পোশাক পরতে, তাই পরব না। আসলে স্থান, কাল, পাত্র বুঝেই সব কিছু মানানসই, সবকিছু সব জায়গার জন্য নয়।

আচ্ছা ভারতের দুটো সামুদ্রিক পর্যটনকেন্দ্র গোয়া এবং পুরী। গোয়ায় বিকিনি পরতে পারব সবার সামনেই, তেমনই সবার মধ্যে পুরীর সমুদ্রে পরতে পারব কি বিকিনি? না আমি পারব না আমার বিবেক বাঁধা দেবে বলে। তবে এখনকার সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে সেটাও হচ্ছে। না নীতিপুলিশি নয়, বাবা-মায়ের সঙ্গে পুরীর সমুদ্রে গিয়ে এ দৃশ্য দেখলে অস্বস্তিবোধ হওয়াটায় কোনও ভুল নেই। ঠিক সেইরকমই আসি মমতা শঙ্করের কথায়। তিনি সোজাসুজি ভাবে শাড়ির শালীনতায় একটা মাপকাঠি টেনেছেন। তাতে কোনও ভুল তো দেখি না। তিনি শাড়ি মানেই ভদ্র এবং অভদ্র দু’ধরন জানেন, তাঁর ভাবনা তিনি জানিয়েছেন। আমরা জানেন তো নিজেদের তথাকথিত স্মার্ট ভাবতে গিয়ে স্বাধীনতা আর অশালীনতার সীমারেখাটাকে গুলিয়ে ফেলছি। শাড়ি পোশাকটা এমনিতেই বাঙালি মেয়েদের সুন্দর করে তোলে, কারণটা কিছুই নয়, এটা তাঁদের পোশাক, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। কিন্তু সেই পোশাককে আরও সুন্দর করার জন্য বুকের খাঁজটা দেখানোর কি প্রয়োজন সব সময়? হ্যাঁ আমরা ঘোমটার বাইরে বেরিয়ে এসেছি, সাধারণত কর্মজীবনে রোজ শাড়ি পরি এমনটা নয়। তাতে তো কোনও অসুবিধা নেই, তাতে তো আঙুল তোলার জায়গা নেই। কিন্তু শাড়ির একটা সৌন্দর্য রয়েছে, যা শুধুমাত্র বক্ষবিভাজিকা দেখানোর জন্য ইচ্ছে করে নামিয়ে পরার কারণে অশালীন দেখায়। 

সবশেষে এটাই বলার, অবশ্যই ধর্ষণ কোনও পোশাক দেখে হয় না। তাই যে পুরুষ বলেন, ‘ছোট পোশাকই ধর্ষণের কারণ।’ তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন। এটা বলা যায় না নাহলে। তেমনই ঠিক এই একই বাক্য ‘ছোট জামা পরলেই কি ধর্ষিত হতে হবে?’ বলে আমরা একটা শালীনতার বাইরে চলে গেলে সেটা স্বাধীনতার নামে নোংরামি করা হয়। এই স্বাধীনতা আর নোংরামির মধ্যে সূক্ষ্ম একটা সীমারেখা রয়েছে, যেটা গুলিয়ে ফেলেছি আমরা ঔদ্ধত্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। ‘বেঢপ’ বলে একটা শব্দ হয়। যার আক্ষরিক অর্থ বেমানান বা সৌষ্ঠবিহীন। আমার যদি মনে হয় আমায় নিজেকে এইভাবে মানাচ্ছে না বা শুধুমাত্র আমি নিজেকে আকর্ষণীয় করার জন্য আমার নিয়মের বাইরে গিয়ে একটু বেশি খোলামেলা হচ্ছি, তবে সেটাকে কি আমরা শুধুই স্বাধীনতা বলতে পারি? একটু ভেবে দেখার সময় এসেছে বোধহয়।

(মতামত ব্যক্তিগত)