পড়ার টেবিল দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ৮

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে (শজিমেক) আধিপত্য বিস্তার এবং হোস্টেলের একটি পড়ার টেবিল দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আট জন আহত হয়েছেন। এ সময় আবাসিক হোস্টেলের ছয়টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে।

বুধবার রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত এ সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার (০২ মে) একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা করেছে কলেজ প্রশাসন। সভা শেষে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ রেজাউল আলম জুয়েল। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। 

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর থেকে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেনের সমর্থকদের সঙ্গে বর্তমান কমিটির সভাপতি শৈশব রায়ের সমর্থকদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছিল। ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেলে একটি পড়ার টেবিল দখলে নেওয়াকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুই পক্ষের হাতাহাতি হয়। এর জেরে বুধবার রাতে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ সভাপতি শৈশব রায়ের সমর্থকরা হোস্টেলের অন্তত ছয়টি কক্ষ ভাঙচুর করেন।

সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে উভয় পক্ষ দাবি করেছে। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের আফ্রাজিম, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের আলী আহমেদ ও সীমান্ত কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমান সভাপতি শৈশব রায় দাবি করেছেন, তার সমর্থকদের মধ্যে আহত রিদওয়ান আলম, তালহা, নাদিম, আরিফ ও দ্বীপরাজকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল আলম বলেন, ‘পড়ার টেবিল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হয়েছে। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ সময় ছাত্রাবাসের ছয়টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। বৃহস্পতিবার একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভায় অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান নিতাই চন্দ্র সরকারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, পুলিশ ও কলেজ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২১ সালে আতিকুরকে সভাপতি ও মোফাজ্জলকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ছয় সদস্যের একটি আংশিক কমিটি ঘোষণা করে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। কমিটি ঘোষণার পরই নেতারা কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন। তাদের অনুসারীরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ওই কোন্দলের জেরে গত বছরের ৩০ মার্চ দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা ও আবাসিক হোস্টেলে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই সময় কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। 

এরই মধ্যে আগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পড়াশোনা শেষ হলে ওই কমিটি বিলুপ্ত করে গত ৮ ফেব্রুয়ারি শৈশব রায়কে সভাপতি এবং মেহেদী হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৪ সদস্যবিশিষ্ট কলেজ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

কলেজ ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, নতুন কমিটিতে কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়ায় সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেনের অনুসারীরা মনঃক্ষুণ্ন হন। কলেজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে বর্তমান সভাপতি শৈশব রায় ও মেহেদী হাসানের অনুসারীদের সঙ্গে মোফাজ্জল হোসেনের অনুসারীদের বিরোধ সৃষ্টি হয়।

ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, নতুন শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে আসার পর থেকেই বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা নবাগত শিক্ষার্থীদের তাদের পক্ষে টানতে তৎপর হয়ে ওঠেন। এর মধ্যে শৈশব রায়ের অনুসারীরা আবাসিক হোস্টেলের একটি পড়ার টেবিল দখলকে কেন্দ্র করে আলী আহমেদ নামে তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন। আলী আহমেদ কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। শৈশব রায়ের অনুসারীরা আলী আহমেদের কাছ থেকে পড়ার টেবিল কেড়ে নেওয়ার পর তার পক্ষ নেন বর্তমান কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ হোসেন, সহসভাপতি মেহেদী হাসান ও তাদের সমর্থকরা। তারা ক্যাম্পাসে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এ নিয়ে মঙ্গলবার রাত থেকে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বুধবার সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে দুই পক্ষ সক্রিয় ছিল। রাত ১০টার দিকে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি ও সংঘর্ষ শুরু হয়।

খবর পেয়ে অধ্যক্ষ ও পুলিশ ঘটনাস্থলে যান। তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় সাবেক সাধারণ সম্পাদক রনির অনুসারী মিনহাজুল ইসলাম, মোহাইমিন ও সীমান্তকে আটক করে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ক্যাম্পাসে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘বর্তমান সভাপতি শৈশব রায়ের নির্দেশে তার অনুসারীদের মধ্যে অর্ঘ্য রায়, তানভির আহমেদ, নির্ঝর সরকার, তোফায়েল তুষারসহ বেশ কয়েকজনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একাংশ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তারা কলেজের ছাত্রাবাসের ২০৩, ২০৪, ২০৬, ৩০২, ৩০৪ ও ৩১২ নম্বর কক্ষে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।’

তবে সহসভাপতি অর্ঘ্য রায় পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। হোস্টেলে একটি পড়ার টেবিল নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দুই পক্ষ হয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়েছেন। কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেনের অনুসারীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্যই এ ঘটনায় আমাদের জড়িয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আমরা ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত চাই।’

কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি শৈশব রায় বলেন, ‘একটি পড়ার টেবিল দখলকে কেন্দ্রে করে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির শিক্ষার্থী বিনা উসকানিতে আমার কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে ৮ থেকে ১০ জনকে আহত করেছেন। এছাড়া ১০১ ও ৪০৯ নম্বর কক্ষে হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের আসবাব ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠনে জরুরি সভা ডাকা হয়েছে।’

শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক আনিসুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আহত কয়েকজনকে জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কেউ ভর্তি আছেন কিনা, তা আমার জানা নেই।’