প্রবীণ বাম রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো আর নেই

বাম রাজনীতির তাত্ত্বিক ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা হায়দার আকবর খান রনো আর নেই। শুক্রবার (১১ মে) দিবাগত রাত ২টা ৫ মিনিটে তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। মৃত্যুকালে তিনি রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ক্রনিক ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হায়দার  আকবর খান রনো যান্ত্রিক অক্সিজেন সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। গত কয়েক দিন ধরে তাকে অধিক অক্সিজেন সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল। খাবার গ্রহণ করতে না পারায় তিনি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। এসব অসুস্থতাসহ তীব্র শ্বাসতন্ত্রীয় অসুখ (টাইপ-২ রেসপিরেটরি ফেইল্যুর) নিয়ে গত ৬ মে সন্ধ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হন।

১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের কলকাতায় হাতেম আলী খান ও কানিজ ফাতেমা মোহসিনার সংসারে জন্ম হায়দার আকবর খান রনোর। তার একমাত্র ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক প্রয়াত হায়দার আনোয়ার খান জুনো।

১৯৫৮ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাসের পর নটরডেম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন রনো। তবে কারান্তরীন থাকায় তিনি স্নাতক শেষ করতে পারেননি। এরপর জেলখানার বসেই পরীক্ষা দিয়ে এলএলবি ডিগ্রি পান। পরবর্তীতে হাইকোর্টের সনদ পেলেও এটিকে পেশা হিসেবে নেননি।

রাজনৈতিক জীবন

১৯৬১ সালে হায়দার আকবর খান রনো তদানীন্তন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে শীর্ষ পর্যায়ে ভূমিকা রাখেন। ওই সময় ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তদানীন্তন সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।

শিক্ষা জীবন শেষে শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন এবং টঙ্গী অঞ্চলে শ্রমিক বস্তিতে বাস করে গড়ে তোলেন এক নতুন ধারার সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলন।

১৯৬৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে উঠে আসেন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন হায়দার আকবর খান রনো।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। ওই সময় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে ১৪টি আধামুক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। এই সংগঠনের প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই অঞ্চলগুলোতে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন শতাধিক।

স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার ছিলেন এই নেতা।

২০১০ সালে মত ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে হায়দার আকবর খান সিপিবিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে তাকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এরপর তিনি সিপিবির উপদেষ্টা হন।

রাজনৈতিক কারণে চারবার কারাবরণ করেছেন তিনি, সাতবার হুলিয়ার কারণে তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। আইয়ুব আমল ও এরশাদ আমলে বারবার তার বাসায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ হানা দিয়েছে।

লেখালেখি

বাংলা সাহিত্য ও বিশ্ব সাহিত্যে এবং একই সঙ্গে পদার্থবিদ্যার সর্বাধুনিক তত্ত্বসমূহ সম্পর্কেও তার একাধিক বই রয়েছে। এছাড়া ক্লাসিক্যাল মার্কসবাদী সাহিত্য পাঠ করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক অবদান রেখেছেন।

মাঠের রাজনীতি ছাড়াও তিনি মার্কসবাদ, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, সাহিত্য ও বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা) সংক্রান্ত বিষয়ে বই ও অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেছেন।

২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে ‘সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা’ নামে প্রথম বই লেখেন তিনি। এটি ছিল পাকিস্তান আমলে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক প্রথম তাত্ত্বিক গ্রন্থ।

বামপন্থি এই নেতার এই পর্যন্ত ২৫টি বই প্রকাশ হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ (২০০৫ সালে বর্ষসেরা বই হিসেবে প্রথম আলোর পুরস্কার লাভ করে), ‘ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’, ‘পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা’, ‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর’, ‘মার্কসবাদের প্রথম পাঠ’, ‘মার্কসীয় অর্থনীতি’, ‘গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাঁধো’, ‘মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম’, ‘কোয়ান্টাম জগৎ- কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন’ (বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত), ‘রবীন্দ্রনাথ শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে’, ‘মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ’ (বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত), ‘বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘স্তালিন প্রসঙ্গে’ (পুস্তিকা), ‘অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’ (পুস্তিকা)।

একইসঙ্গে ‘মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা’ এবং ‘নারী ও নারীমুক্তি’ নামে দুটি বই সম্পাদনা করেছেন তিনি।