নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না কেন?

রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট নৌ টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন রুটে প্রায় শতাধিক লঞ্চ চলাচল করে। এছাড়াও ছোট-বড় মালবাহী এবং যাত্রীবাহী ট্রলার ও খেয়া নৌকা যাতায়াত করে সদরঘাটের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে। তবে অধিকাংশ নৌযানে নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, মানা হচ্ছে না নিরাপত্তা নীতিমালাও। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালানো ও জরিমানার ঘটনা ঘটলেও সচেতনতা বাড়ানোয় গুরুত্ব নেই সংশ্লিষ্টদের। দিনের পর দিন এভাবেই যাত্রী নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করছে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও সঠিক তদারকির অভাবে নিশ্চিত হচ্ছে না নৌ নিরাপত্তা। পাশাপাশি বিদ্যমান আইনকে সময়োপযোগী করে ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের নৌপথকে নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় রূপ দেওয়া সম্ভব।

আজ ২৩ মে জাতীয় নৌ-নিরাপত্তা দিবস। স্বাধীনতার এত বছর পরও নদীমাতৃক বাংলাদেশে নিরাপদ করা যায়নি নৌপথকে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গত বছর নৌপথে ১৪৮টি দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত, ১৫২ জন আহত এবং ১০৯ জন নিখোঁজ রয়েছে।

সরেজমিন সদরঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পদ্মা সেতু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ শুরু হওয়াতে বরিশাল রুটের লঞ্চগুলো যাত্রী খরায় পড়েছে। তবে ভোলা, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জসহ অন্য রুটের লঞ্চগুলোর চাহিদা এখনও আগের মতোই। এছাড়াও প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে ঘাটে আসছে সবজি ও বিভিন্ন পণ্য। আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় ট্রলারে করে যাতায়াত করছেন মানুষ। নিয়মিত খেয়া নৌকাতে ঘাট পার হচ্ছেন যাত্রীরা।

অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল আইন ২০১৯-এর ৬২ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে, নৌযান ডুবি, অগ্নিকাণ্ড, সংঘর্ষ, বিস্ফোরণ ইত্যাদি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ও মোকাবিলার জন্য নির্ধারিত জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সজ্জিত না হয়ে এবং অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ ও সংঘর্ষ এবং অন্যান্য দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া কোনও অভ্যন্তরীণ নৌযান বাণিজ্যিক উদ্দেশে বহন করা যাবে না।

যদিও পন্টুনে যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ লঞ্চগুলো ঘুরে দেখা যায়, লঞ্চের প্রবেশমুখে ধারণক্ষমতাসহ নিরাপত্তাসামগ্রীর পরিমাণ উল্লেখ করা আছে। বরিশাল রুটের বিলাসবহুল লঞ্চগুলোতে সংখ্যা অনুযায়ী নিরাপত্তা সরঞ্জাম কাছাকাছি থাকলেও চাঁদপুরের ইলিশা, ভান্ডারিয়া, হাতিয়াসহ অন্য ঘাটগুলোতে চলাচলকারী মাঝারি লঞ্চগুলোর তালিকায় বয়া ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের যে সংখ্যা বলা আছে তা লঞ্চ ও যাত্রীর তুলনায় অপ্রতুল। এসব লঞ্চে থাকা বয়াগুলোও বেশ পুরানো। এছাড়াও লঞ্চকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যবহার সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ বা ধারণা নেই তাদের।

ফারহান-২ লঞ্চের স্টাফ খাইরুল বলেন, ‘আমাদের তেমন প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই। লঞ্চে তো তেমন দুর্ঘটনাও হয় না। সিনিয়র যারা আছেন, তারা জানেন কীভাবে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র চালাতে হবে।’

কোনও কোনও লঞ্চের প্রবেশমুখে ধারণক্ষমতাসহ নিরাপত্তাসামগ্রীর পরিমাণ উল্লেখ করা থাকলেও বাস্তবের সাথে মিলে না গত মঙ্গলবার সুন্দরবন-১৫ লঞ্চটি ঘাটে অপেক্ষা করছিল ছেড়ে যাওয়ার জন্য। লঞ্চের ডেকে থাকা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও জানেন না নিরাপত্তা সরঞ্জাম সম্পর্কে। ডেকের উপরে বয়া রাখা থাকলেও তা কীভাবে হাতে পাবেন বা ব্যবহার করবেন জানেন না তারা।

লঞ্চের যাত্রী রকীব ইসলাম বলেন, ‘লঞ্চে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটে, তবে দুর্ঘটনা ঘটলে কী করবো তা কখনও ভাবা হয়নি। এখানে বয়া রাখা থাকে সবসময় দেখি। তবে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানা নেই।’

এখানেই শেষ নয় লঞ্চের ওঠা-নামার সিঁড়িতেও নেই নিরাপত্তা রেলিং। গত ১১ এপ্রিল সদরঘাটে ১১ নম্বর পন্টুনের সামনে দুটি লঞ্চের মাঝখান দিয়ে ফারহান নামে আরেকটি লঞ্চ ঢোকানোর সময় এমভি তাসরিফ-৪ লঞ্চের রশি ছিঁড়ে আঘাতে পাঁচ যাত্রী গুরুতর আহত হন। পরে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার পর বিআইডব্লিটিএ অভিযান চালিয়ে লঞ্চের ওঠা-নামার সিঁড়িতে রেলিং না থাকায় কয়েকটি লঞ্চকে জরিমানা করে। তবে সে ঘটনার একমাস পার না হতেই আবারও রেলিং বাদেই যাত্রী ওঠা-নামা করাচ্ছে লঞ্চগুলো।

বেশিরভাগ লঞ্চের ওঠা-নামার সিঁড়িতেও নেই নিরাপত্তা রেলিং সার্বিক বিষয়ে কথা বলা হলে লঞ্চ মালিক সমিতির সদস্য বিএম আলী আকবর বলেন, ‘বিআইডব্লিওটিএ থেকে আমাদের যেভাবে ইন্সট্রাকশন দেওয়া হয় সেভাবেই আমরা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। স্টাফদেরও ট্রেনিং করানো থাকে। তবে কিছু কিছু লঞ্চে সমস্যা থাকে। আমরা সেসব কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। আমরা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বয়া, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসহ সবকিছুই নির্দেশনা মতো লঞ্চে রাখার চেষ্টা করি। এটা শুধু যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয় না, আমাদেরও সম্পদ রক্ষার বিষয়।’

অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল আইন ২০১৯-এ অভ্যন্তরীণ নৌযানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলারত সব প্রকার নৌযান যা সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস অথবা অন্যকোনও যান্ত্রিক শক্তি দ্বারা চালিত। পালচালিত নৌযান, ডামবার্জ অথবা অন্য যেকোনও নৌযান যা যন্ত্রচালিত নয়। গুণ টানা নৌযান ও অন্য যেকোনও নৌযান যা যন্ত্রচালিত নৌযান দ্বারা টেনে অথবা ঠেলে চালনা করা হয়।

নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না কেন? সদরঘাটে লঞ্চ ছাড়াও নিয়মিত চলাচল করা ট্রলার ও খেয়া নৌকাগুলোতেও দেখা যায়নি কোনও নিরাপত্তা সরঞ্জাম। ট্রলারগুলোতে নেই কোনও বয়া বা লাইফ জ্যাকেট। ধারণক্ষমতার দুই-তিনগুণ যাত্রী নিয়েই চলাচল করতে দেখা যায় তাদের। কিছু খেয়া নৌকায় একটি করে বয়া থাকলেও অধিকাংশ খেয়াতে তা নেই। ট্রলারগুলোতে নেই কোনও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও।

কথা হয় মুন্সীগঞ্জ থেকে সবজি নিয়ে আসা ট্রলার চালক খালেদের সঙ্গে। নিরাপত্তা সরঞ্জাম সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বা বয়া কিছুই নেই তার ট্রলারে। তিনি বলেন, ‘এগুলোর দরকার আছে বুঝি কিন্তু কেনা হয়নি।’

লঞ্চ ছাড়াও নিয়মিত চলাচল করা ট্রলার ও খেয়া নৌকাগুলোতেও দেখা যায়নি কোনও নিরাপত্তা সরঞ্জাম গত বুধবার সকালে সোয়ারিঘাটে থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাট এলাকার ওয়াইজঘাটে থামে একটি ট্রলার। ট্রলারটিতে বসে ও দাঁড়ানো অবস্থায় অন্তত পঞ্চাশের বেশি যাত্রী ছিল। ধারণক্ষমতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রলার চালক সোহাগ বলেন, ‘ধারণক্ষমতা তো আমার জানা নেই। যাত্রী যতজন পাই নিয়ে চলে আসি। কোনও সময় দশজন হয় কোনোসময় পঞ্চাশ জনও হয়। সকালের দিকে বেশি যাত্রী হয় শুধু।’

এখানেই শেষ নয় চলন্ত লঞ্চে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাত্রী ওঠানোর কাজ করতে দেখা যায় ইঞ্জিনচালিত খেয়া নৌকাগুলোকে। লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার পর কোনও যাত্রী পন্টুনে এলে ওই নৌকার মাঝিরা তাদের লঞ্চে পৌঁছে দেন। বিনিময়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পান তারা। এভাবে চলন্ত লঞ্চে যাত্রী পরিবহনেও যেকোনও সময় ঘটতে পারে প্রাণহানির ঘটনা।

চলন্ত লঞ্চে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাত্রী ওঠানোর কাজ করতে দেখা যায় ইঞ্জিনচালিত খেয়া নৌকাগুলোকে সার্বিক বিষয়ে কথা বলা হলে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, যেসব লঞ্চে নিরাপত্তা ত্রুটি আছে তাদের অর্থদণ্ড করা হচ্ছে। আনফিট লঞ্চের বন্দরে আসার সুযোগ নেই। যেসব লঞ্চের সার্ভে সনদ নেই তারা ঘাটে লঞ্চই রাখতে পারবে না। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন যাতে না হয় সেটার তদারকিও অব্যাহত আছে।

বিশেষজ্ঞ আর সচেতন মহল বলছে, দেশের নৌপথে যে সম্ভাবনা আছে, তা সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য করে তোলা সম্ভব। এছাড়া আইন সংশোধন করে ছোট নৌযানগুলোকে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি সঠিক তদারকির মাধ্যমে নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়টি যারা দেখবে তারাই যদি আইন না জানে তাহলে প্রয়োগ তারা কীভাবে করবে। জীবনরক্ষাকারী যেসব সরঞ্জাম নৌযানে থাকে বয়া বা লাইফ জ্যাকেট তার ৩-৪ গুণ যাত্রী পরিবহন করা হয়। সার্ভে সনদে নিরাপত্তা সরঞ্জামের যে সংখ্যাটা থাকে সেটাও নৌযানে থাকে না। প্রতিবছর নৌযানের নিবন্ধন করার কথা কিন্তু তারা করছে না। লক্ষাধিক নৌযানের নিবন্ধন নেই।

তিনি আরও বলেন, ‘আসলে আইন কার্যকর হয় না, আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালিকরা বাধ্য। যখন কোনও ঘটনা ঘটে তখন দেখানোর জন্য কিছু কার্যক্রম করা হয়। একটা দুর্ঘটনা হলে দেখা যায় লঞ্চের নিবন্ধন নাই, সারেং-এর সার্টিফিকেট নেই, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল না।’

অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালানো হলেও পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি নেই বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের নৌ পরিবহন ব্যবস্থাকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। নৌ যোগাযোগ আমাদের দেশে সব সময় অবহেলিত হয়েছে। সড়ক পথে আমরা যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছি বিগত ২-৩ যুগে, এখন রেলপথে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে, নৌপথে আমাদের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমাদের নৌপথ প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট, একসময় নদীর ওপর আমাদের নির্ভরতা ছিল। সাশ্রয়ী, নিরাপদ, প্রযুক্তিনির্ভর করার ক্ষেত্রে যে ধরনের উদ্যোগ দরকার ছিল, কাঠামোগতভাবে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।’

বুয়েটের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘অবহেলার ফলে নৌপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখানে অনেক দুর্বলতা আছে। এখনও সুযোগও আছে, নৌপথ যেহেতু সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা, সেই সুযোগটা আমাদের নিতে হবে। এর জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা, আইন ও প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে।’

ট্রলার ও ছোট নৌযানগুলোর ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মির তারেক আলী বলেন, ‘আমাদের নৌপথ সবকিছু ১৯৭৬-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলে। কিন্তু এই আইনে এখন সবকিছু আসে না। বিশেষ করে ছোট যানগুলো এখন আইনের আওতায় আসে না। এগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী নিলেও তো আইনে নাই। তাই আইনটা সংশোধন দরকার।’