ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে দেশের উপকূলীয় জেলা ভোলা। জেলার সাত উপজেলার প্রায় প্রত্যেক ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙেছে শহর রক্ষা বাঁধ। তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ ও গবাদিপশু। তলিয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। উপড়ে পড়েছে কয়েক হাজার গাছপালা। ঘর চাপায় ও গাছের আঘাতে নারী-শিশুসহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। চরম উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে দুই লাখ মানুষের। সবমিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া তথ্যমতে, রিমালের তাণ্ডবে জেলার মেঘনা নদী তীরবর্তী অন্তত ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি মনপুরার তিন ইউনিয়নের ৯টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ও ঘরবাড়িতে পানি ঢুকেছে। প্লাবিত হয়েছে অধিকাংশ গ্রাম। ফলে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে জেলার সাত উপজেলার বেশিরভাগ গ্রামে পানি ঢুকেছে। সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলার মেঘনা তীরবর্তী অন্তত ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জোয়ারের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মনপুরা উপজেলার অন্তত ছয় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ধসে গেছে। সাকুচিয়া দক্ষিণ ইউনিয়ন, মনপুরা ও হাজিরহাট ইউনিয়নের ৯টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে গেছে। এসব বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় লোকালয়ের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। দ্রুত বাঁধগুলো সংস্কার পুনরায় নির্মাণের ব্যবস্থা নেবো আমরা।’
সাকুচিয়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. অলিউল্যাহ কাজল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মনপুরা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমার ইউনিয়নের সবগুলো গ্রাম। ইউনিয়নের তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে মানুষজন পান্দিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এছাড়া দক্ষিণ সি-বিচ পয়েন্ট, নুরুদ্দিন মার্কেটের পূর্বপাশ, ঢালি মার্কেটের পূর্বপাশ ও উত্তর তালতলা বাজারের দক্ষিণ পাশের বাঁধ ভেঙে গেছে। ওসব এলাকার বাসিন্দারাও পানিবন্দি অবস্থায় দুর্ভোগে আছেন। এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি।’
৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকার কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. হাসান ওয়ারিসুল কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রিমালের তাণ্ডবে পাঁচ হাজার হেক্টর আউশ ধান এবং ১০ হাজার ৭৯১ হেক্টর জমির শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো পানিতে পচে যাবে। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ ৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা।’
ভেসে গেছে ১৪ কোটির মাছ
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানিয়েছেন, জলোচ্ছ্বাসে জেলার ৯ হাজার ৯২৮টি পুকুর এবং এক হাজার ৪৩৯ ঘেরের ৭৫৬ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। যার মূল্য ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এছাড়া ১১ দশমিক ছয় মেট্রিক টন চিংড়ি ভেসে গেছে; যার মূল্য এক কোটি সাত লাখ টাকা। পাশাপাশি এক কোটি ৬০ লাখ টাকার কৃষি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ১৮৪টি মাছ ধরা নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাত কোটি টাকার গবাদি পশু মারা গেছে
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খাঁন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলায় ১৭৬ গরু, ২৬৯ মহিষ, ১৪৫ ছাগল, ২১৮ ভেড়া ভেসে মারা গেছে। এছাড়া ৯ হাজার ৬১৪টি মুরগি এবং পাঁচ হাজার ১৬০টি হাঁস মারা গেছে। সবমিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সাত কোটি টাকার বেশি। আরও বাড়তেও পারে।’
দুর্যোগকবলিত দুই লাখ মানুষ
জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার পাঁচ পৌরসভা ও ৭০ ইউনিয়নের মধ্যে ৬০ ইউনিয়নের ৫২৩টি ওয়ার্ড ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত হয়েছে। দুর্যোগকবলিত মানুষের সংখ্যা দুই লাখ ২৩ হাজার ৩০৩ জন। সাত হাজার ৬২৩ বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে দুই হাজার ৪৬৫টি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ১৫৮টি। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চলের ৩০ গ্রাম। এখনও পানি নামেনি। ফলে বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি আছে।
জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অতীতে যেসব ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, ঝড় কেটে যাওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রিমালের আঘাত টানা দুদিন ছিল। ফলে জেলার সব উপজেলায় মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমরা সব দফতরের দায়িত্বশীদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে।’
বিদ্যুৎ, নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জেলাবাসী
স্থানীয় সূত্র জানায়, সদর উপজেলার রামদাসপুর, চটকিমারা, মাঝেরচর, বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুর, হাসাননগর, পক্ষিয়া, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর, সৈয়দপুর, চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, চরকুকরি মুকরি, মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট, উত্তর সাকুচিয়া, দক্ষিণ সাকুচিয়া, চরকলাতলীসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। দুর্গত এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি।
মঙ্গলবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। কোথাও দমকা হাওয়া আবার কোথাও হালকা বৃষ্টি অব্যাহত আছে। জেলা শহরের কিছু এলাকায় সকালে বিদ্যুৎ এলেও বেশিরভাগ এলাকা অন্ধকারে আছে।
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) ভোলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইউসুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভোলায় আমাদের গ্রাহক ৫০ হাজার। মঙ্গলবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ২৮ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ পেয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে লাইনের ওপর গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে গেছে। কোথাও খুঁটি ভেঙে পড়েছে। সেগুলো সারানোর কাজ চলছে। বুধবারের মধ্যে সবার মাঝে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।’
জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. খালেদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক চার লাখ ২৮ হাজার। মঙ্গলবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত অন্তত দুই লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ পেয়েছেন।’
রিমালের তাণ্ডবে পল্লী বিদ্যুতের ৬৫টি খুঁটি ভেঙে গেছে জানিয়ে খালেদুল ইসলাম বলেন, ‘সেগুলো পুনরায় বসানোর কাজ চলছে। সব খুঁটি বসানো হলে পর্যায়ক্রমে সব গ্রাহক বিদ্যুৎ পাবেন। রবিবার সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক হয়নি। বিদ্যুৎ সব স্থানে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
মৃতদের ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে
ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে মারা যাওয়া প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি হবে। সব বিভাগের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগিতা এলে ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হবে।’