সৃৃজন হারতেই যাদবপুরের মানুষকে গঞ্জনা ফেসবুকের বামপন্থীদের!

‘যাদবপুরে নাকি শিক্ষিত লোক থাকে? সায়নী ঘোষ নাকি এখানে এগিয়ে…’ সৃজনের পরাজয়ের আসার সঙ্গে সঙ্গে এমনই সব পোস্ট ভেসে এলো ফেসবুক জুড়ে। করলেন সিপিআইএমেরই কর্মী-সমর্থকরা। শিক্ষিত, বামপন্থা, শ্রমজীবী এই শব্দগুলোর মানে কি ভুলে গেল বঙ্গ-সিপিআইএম ব্রিগেড! দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র বাংলার রাজ্য রাজনীতি কিংবা দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও হট ফেভারিট সিটগুলির অন্যতম। বারুইপুর পূর্ব ও পশ্চিম, সোনারপুর, ভাঙড়, যাদবপুর, সোনারপুর উত্তর আর টালিগঞ্জ বিধানসভাগুলি কেন্দ্রেজুড়ে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে এই লোকসভা কেন্দ্র গঠিত। এবারের নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল অভিনেত্রী সায়নী ঘোষকে, অন্যদিকে সিপিআইএমের প্রার্থী ছিলেন ছাত্রছাত্রী আন্দোলন থেকে সদ্য অবসর নেওয়া সৃজনকে। আর বিজেপি’র পক্ষ থেকে এই কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছিলেন অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।

দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর সহ বিস্তৃত অঞ্চল ছিল একসময়কার উদ্বাস্তু আন্দোলনের মাটি। সেই ১৯৬০-১৯৭০-এর দশক থেকেই নকশালপন্থী বিপ্লবী রাজনীতি থেকে সংসদীয় বামপন্থী রাজনীতি, বিভিন্ন ধারার বামেদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল এই অঞ্চলে। অন্যদিকে গ্রামীণ ভাঙড়, গ্রাম-মফস্বল ঘেরা সোনারপুর, বারুইপুর অঞ্চলও বাংলার রাজনৈতিক আঙিনায় গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। ৩৪ বছরের শাসনকালেও এই কেন্দ্রটি একাধিকবার হাতছাড়া হয়েছে সিপিআইএমের। দক্ষিণ কলকাতাকে কেন্দ্র করেই তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান হওয়ায় তাদের কাছেও প্রেস্টিজ ফাইট ছিল এই কেন্দ্র।

সৃজনশীল যাদবপুর গড়ে তোলো, কিংবা যাদবপুরের সৃজন ট্যাগ লাইনজুড়ে প্রচারে ঝড়ে তুলেছিলেন সিপিআইএম নেতা-কর্মীরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বাম ছাত্র রাজনীতির প্রভাবকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল বামফ্রন্ট নেতৃত্ব। আপাতভাবে শহরাঞ্চলে জনসমর্থন পেলেও নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে ডালা ফেল সৃজন। ইলেকশন কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে সায়নীর প্রাপ্ত ভোট যেখানে ৭ লাখ ১৭ হাজার ৮৯৯, বিজেপি প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত ভোট ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯৮, সেখানে সিপিআইএমের যুবনেতা সৃজন ভট্টাচার্যের প্রাপ্ত ভোট ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭১২।

প্রসঙ্গত গতবার বিকাশ রঞ্চনের প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় ৪০ হাজারের বেশি ভোট কম পেয়েছেন সৃজন। পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সিপিআইএম কর্মী-সমর্থকদের আশা-ভরসা ছিল বটে, পরিশ্রমও করেছিলেন তাদের সাধ্যমত। কিন্তু, প্রথমত, একদা বাংলা শাসকদলের কর্মী-সমর্থনকের অনুমান ছিল বাস্তব বিচ্ছিন্ন। কিছু ক্ষেত্রে শহুরে মধ্যবিত্ত অংশ সিপিআইএমে ভোট দিলেও শহুরে শ্রমজীবী কিংবা গ্রামীণ প্রান্তিক বর্গের জনগণের থেকে আজও অনেকখানি তফাৎ তাদের। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন সর্বস্ব রাজনীতির আঙিনাতেও বাস্তবের গণ আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন ব্যাতিরেকে কোনও ‘বামপন্থী’ দল সাফল্য পেতে পারে না, তাও প্রমাণিত হল সৃজনের এমন ফলাফলে।

দেশ ও রাজ্যজুড়ে বামপন্থী রাজনীতি, শ্রমিক আন্দলনের ভাটার সময়ে যে কোনো ধারার বামেদেরই সংকটকাল। তৃণমূল কিংবা বিজেপি, অর্থাৎ ডানপন্থী দলগুলিকেই একে অন্যের বিকল্প ভেবে মানুষ জনমত দিচ্ছেন বাংলাতেও। এমন সময়ে বামপন্থী রাজনীতি করতে আসা সিপিআইএম কর্মীদের ‘ওভার হাইপড’ ভঙ্গিমা-আচরণ জনগণ, বাস্তবের মাটি থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করবে তাদের। ফলাফলের পরে আলিমুদ্দিনে আত্মসমীক্ষা চলবে, কিন্তু মধ্যবিত্ত সমর্থনবাহিনী আর সোশাল মিডিয়ার বাইরে আজও শূন্য সিপিআইএম। না, কেবল আসন সংখ্যায় নয়, বেসিক বাম রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও।