চট্টগ্রামে কোরবানির প্রাণীর হাটে খুঁটি বাণিজ্যের অভিযোগ

ঈদুল আজহা যতই ঘনিয়ে আসছে চট্টগ্রামে জমে উঠছে প্রাণীর হাটগুলো। চট্টগ্রাম নগরীতে অনুমোদিত হাট আছে ১০টি এবং নগরীর বাইরে ১৫টি উপজেলায় আরও ২০০টির মতো স্থায়ী এবং অস্থায়ী হাট বসেছে। শুক্রবার (১৪ জুন) থেকে প্রাণীর হাটগুলোতে লোকজনের ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বেচা-বিক্রিও। তবে বিক্রেতারা জানিয়েছেন, নগরীর হাটগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিক্রেতাদের কাছ থেকে নানাভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন ইজারাদাররা। এমনকি গরু বেঁধে রাখার খুঁটি বাবদ আদায় করা হচ্ছে গরুপ্রতি চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এই ‘খুঁটি বাণিজ্যের’ কারণে গরুর দাম বাড়ছে।

ফরিদপুরের মদুখালী থেকে ১৫টি গরু বিক্রির জন্য চট্টগ্রাম নগরীর বিবিরহাটে এনেছেন আরিফ। তিনি মঙ্গলবার (১১ জুন) এ হাটে আসেন। আরিফ জানান, এসব গরু বিবিরহাট হাট পর্যন্ত আনতে ট্রাকভাড়া দেওয়া হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা। আসার সময় সড়কের বিভিন্ন স্থানে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা কিংবা আরও বেশি চাঁদা দিতে হয়েছে। বাজারে আনার পর ১৫টি গরুর খুঁটি বা খাইন ভাড়া বাবদ দিতে হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এসব গরুর দেখভালের জন্য রাখা হয়েছে পাঁচ জন কর্মচারী। এখন পর্যন্ত একটিও বিক্রি হয়নি।

আরিফের মতো একই অভিযোগ করলেন বিবিরহাট হাটে গরু বিক্রি করতে আসা মোহরম আলী। তিনি বলেন, ‘আমি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা থেকে ২১টি ছোট এবং মাঝারি আকারের গরু বিবিরহাটে এনেছি। ট্রাকভাড়া দিতে হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। অথচ গত বছর গাড়িভাড়া দিয়েছি ২৫ হাজার টাকা। এবার ২০ হাজার টাকা বেশি দিতে হয়েছে। বাজারে আসার পর গরু রাখার জন্য খুঁটি ভাড়া দিতে হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। সোমবার (১০ জুন) এসব গরু বিবিরহাটে আনা হলেও এখন পর্যন্ত একটিও বিক্রি হয়নি। অথচ আনা থেকে খুঁটি ভাড়া সব মিলিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, এবার সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত প্রাণীর হাট রয়েছে ১০টি। এর মধ্যে স্থায়ী তিনটি। সাগরিকা গরু হাট, বিবিরহাট গরু হাট এবং পোস্তারপাড় ছাগলের বাজার। অস্থায়ী ৭টি হাটের মধ্যে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে কর্ণফুলী হাট (নুরনগর হাউজিং এস্টেট হাট), ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের বাটারফ্লাই পার্কের দক্ষিণে টি কে গ্রুপের খালি মাঠ, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে পূর্ব হোসেন আহমদপাড়া সাইলো রোডের পাশের টিএসপি মাঠ, একই ওয়ার্ডে মুসলিমাবাদ রোডের সিআইপি জসিমের খালি মাঠ, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে বড়পোল সংলগ্ন মহেশ খালের দুই পাড়ের খালি জায়গা, ৩৯ নম্বর আউটার রিং রোডের সিডিএ বালুর মাঠ এবং ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম হালিশহর মুনিরনগর আনন্দ বাজার সংলগ্ন রিং রোডের পার্শের খালি জায়গা।

এদিকে, চসিকের অনুমোদিত দশটি প্রাণীর হাটের মধ্যে নয়টির ইজারাদার পাওয়া গেলেও তিন দফা দরপত্র আহ্বান করে ইজারাদার পাওয়া যায়নি বিবিরহাট হাটের। এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী এ হাটটি নানা অনিয়মের কারণে জৌলুস হারিয়েছে।

সিটি করপোরেশনের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় অবস্থিত বিবিরহাট হাটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর থেকে গত ২২ বছর ধরে স্থায়ী এ হাট চসিকের রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ২০২০ সালে বিবিরহাট গরু বাজারের ইজাহা হয় ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকায়। পরের বছর ২০২১ সালে ৬ শতাংশ বেড়ে সেটি প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। ২০২২ সালে এ হাট ইজারা হয় ২ কোটি ১৪ লাখ টাকায়। ২০২৩ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কয়েক দফা ইজারাদার খুঁজেও পায়নি চসিক। পরে স্থানীয় কাউন্সিলর মোবারক আলীর তত্ত্বাবধানে এ হাটে খাস খালেকশন করে সিটি করপোরেশন। এতে ৫০ লাখ টাকা পেয়েছিল চসিক।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, চসিক কাউন্সিলর মোবারক আলীর ভয়ে এবারও কেউ বাজারটি ইজারা নিতে সাহস পায়নি। এ জন্য সিটি করপোরেশন বার বার দরপত্র আহ্বান করেও ইজারাদার পায়নি। সেখানে খাস খালেকশন করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে চসিক কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, ‘ইজারাদার নিয়োগের জন্য সিটি করপোরেশন চারবার দরপত্র আহ্বান করেছিল। বাজারটি নেওয়ার জন্য কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনি। গত বছরও বাজারটিতে কোনও ইজারাদার ছিল না। গতবার খাস কালেকশন করা হয়েছিল। এবারও খাস কালেকশন করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘গত ৯ জুন বিবিরহাট হাটটি আমার তত্ত্বাবধানে পরিচালনার জন্য সিটি করপোরেশন দায়িত্ব দিয়েছে। এখানে বিক্রেতাদের কাছ থেকে খুঁটিবাণিজ্যের নামে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সুযোগ নেই কিংবা এমন করা হচ্ছে না।’

নুরনগর হাউজিং এস্টেট হাটের ইজারাদার সাইফুল আলম বলেন, ‘এখনও পুরোপুরি বিক্রি জমে ওঠেনি। কোরবানির দিন যতই ঘনিয়ে আসবে বিক্রিও বাড়বে বলে আশা করছি। হাটের বিষয়ে জেলা প্রশাসন যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলো পূরণের বিষয়ে আমরা সজাগ আছি। আমরা বেপারিদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কোনও টাকা আদায় করছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ হাটে বগুড়া, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, লালমনির হাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেপারিরা গরু নিয়ে আসছেন। অনেক গরু এখনও পথে রয়েছে। এর বাইরেও আমাদের চট্টগ্রামের খামারিদেরও অনেক গরু রয়েছে।’

এদিকে, গ্রামের হাটগুলোর চেয়ে শহরের হাটগুলোতে বেচাকেনা এখনও কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরে কোরবানির প্রাণী রাখার জন্য অনেকের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তার ওপর লালন-পালনেও সমস্যা। এ কারণে শহরের লোকজন কোরবানির এক-দুইদিন আগে প্রাণী কিনে থাকে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত হাটের বাইরে অ্যাগ্রো খামারগুলোতেও বিক্রি হচ্ছে কোরবানির প্রাণী। চট্টগ্রামের নাহার অ্যাগ্রো লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ তানজিব জাওয়াদ রহমান বলেন, ‘এখনও বিক্রি পুরোপুরি জমে ওঠেনি। কোরবানি উপলক্ষে আমাদের খামারে পাঁচ শতাধিক গরু মোটাতাজা করা হয়েছে। আশা করছি এখন বেচা-বিক্রি বাড়বে।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘এবার ঈদুল আজহায় চট্টগ্রামে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬৫টি প্রাণী কোরবানি দেওয়া হবে। এর মধ্যে ৫ লাখ ২৬ হাজার ৪৭৫টি গরু, ৭১ হাজার ৩৬৫টি মহিষ, ১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৩টি ছাগল, ৫৮ হাজার ৬৯২টি ভেড়া এবং অন্যান্য প্রাণী ৮৮টি। এর বিপরীতে কোরবানির জন্য মজুত রয়েছে ৮ লাখ ৫২ হাজার ৩৫৯টি প্রাণী।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাণীর হাট ঘিরে খুঁটি বাণিজ্য কিংবা অন্য কোনও বাণিজ্য হওয়ার বিষয়ে অভিযোগ পায়নি। পেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’