৩ বছরেও শুরু হয়নি মামলার বিচার

২০২১ সালের ১৬ মে রাজধানীর পল্লবীতে নিজের শিশু সন্তানের সামনে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী শাহিন উদ্দিনকে। এ ঘটনার নিহতের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে রাজধানীর পল্লবী থানায় ২০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। মামলা দায়েরের তিন বছর পার হলেও এখনও শুরু হয়নি এই মামলার বিচার। কবে নাগাদ বিচার শুরু হবে, তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। মামলা দায়েরের পর লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এমএ আউয়ালসহ ১৯ আসামিকে গ্রেফতার করেন পুলিশ। তদন্ত সংস্থা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তাদের ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। তবে দুটি অভিযোগপত্রে বাদীপক্ষ নারাজি দিলে আদালত অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।

নিহত শাহিন উদ্দিনের মা আকলিমা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসামিরা প্রকাশ্যে আমার ছেলেকে খুন করেছে, দেশবাসী সবাই জানে। তারা কিছুদিন জেলখেটে জামিনে মুক্ত হয়ে এখন প্রকাশ্যে ঘুরছে। আসামির জামিন পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমার পরিবার খুবই আতঙ্কিত। আসামিরা সবসময় আমার চোখের সামনে ঘোরাফেরা করছে। একজন মা হয়ে কীভাবে তা সহ্য করি? তারা নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছে, উৎপাত করছে। আমাদের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার চিন্তাভাবনাও করছে। মানুষ খুন করেও তাদের ক্ষমতা রয়ে গেছে। আমার মাথায় আসে না, প্রকাশ্যে খুনের আসামিরা কীভাবে জামিন পায়!

ব্যবসায়ী শাহিনের হত্যাকাণ্ডের দিন তার সঙ্গেই ছিল শিশু সন্তান মাশরাফি। আকলিমা বেগম বলেন, ‘আমার নাতি মাশরাফি তার বাবার খুনিদের দেখলে ভয়ে কাঁপতে থাকে। চোখের সামনেই তার বাবাকে খুন করা হয়েছে, সেই স্মৃতি মাশরাফি এখনও ভোলেনি। বাবার কথা প্রায় সে বলে আর কান্নাকাটি করে। মামলায় যতই সময় লাগুক না কেন, আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’ জড়িত সব আসামির ফাঁসির দাবি করেন নিহত শাহিন উদ্দিনের মা আকলিমা বেগম।

রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, মামলাটি এখনও অভিযোগপত্র দাখিল হয়নি। আদালতে মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র আসা মাত্রই রাষ্ট্রপক্ষ দ্রুত বিচার কাজ শেষ করতে পদক্ষেপ নেবে।

এদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, যারা এই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তারা সকলেই ষড়যন্ত্রের শিকার। আদালত ন্যায়বিচারের স্বার্থে সব আসামির জামিন দিয়েছেন। আশা করছি, সকল আসামিরা এই মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন। আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন।

আদালতের পল্লবী থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা উপপরিদর্শক সেলিম রেজা জানান, এই মামলার সব আসামি জামিনে কারামুক্ত রয়েছে। বর্তমানে সিআইডি অধিকতর তদন্ত করছেন। তবে কোনও তদন্ত প্রতিবেদন আসেনি। আগামী ১৬ জুলাই এ মামলার অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।

জানা যায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমএ আউয়ালসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার হোসেন। ২০২২ সালের ১২ মে আদালত শাহিন উদ্দিনের মা আকলিমার নারাজির আবেদন গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে পিবিআইকে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মনির হোসেন আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তাতেও আপত্তি জানিয়ে নারাজি আবেদন করলে সেই আবেদন গ্রহণ করে সিআইডিকে মামলাটি তদন্তের আদেশ দেন। বর্তমানে সিআইডি এ মামলার তদন্ত করছে।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের ১৬ মে বিকাল ৪টার দিকে সুমন ও টিটু নামের দুই যুবক শাহিন উদ্দিনকে জমির বিরোধ মেটানো হবে জানিয়ে ফোন করে ডেকে নেয়। শাহিন মোটরসাইকেলে পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাসার সামনে গেলে সুমন, টিটুসহ ১৪ থেকে ১৫ জন মিলে তাকে টেনেহিঁচড়ে ওই বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যায়। এ সময় শাহিন উদ্দিনের ছয় বছরের ছেলে মাশরাফি গেটের বাইরে ছিল। গ্যারেজে ঢুকিয়ে শাহিনকে সন্ত্রাসীরা চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এরপর তাকে ওই গ্যারেজ থেকে বের করে ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে আবার কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

মামলার পর প্রধান আসামি লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এমএ আউয়ালসহ ১৯ আসামিকে গ্রেফতার করেন পুলিশ। বর্তমানে সবাই জামিনে। জামিনে থাকা অন্য আসামিরা হলো তরিকুল ইসলাম, সুমন ব্যাপারী, মো. মুরাদ, নজরুল হাসান বাবু, রবি তালুকদার, গোলাম কিবরিয়া, মো. দিপু, নুর মোহাম্মদ হাসান, আবু তাহের, মো. টিটু, ইকবাল নুর, তুহিন মিয়া, হারুনুর রশিদ, মো. শরিফ, জহিরুল ইসলাম, কালা বাবু ও মো. লিটন।

লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ইসলমী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এমএ আউয়াল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে শাহিন উদ্দিন কখনও ব্যবসায়ী ছিল না। ২৬ বছর বয়সে তার নামে ৩৬টি মামলা ছিল। এলাকাবাসী জানেন, সে (শাহিন উদ্দিন) সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। মামলার বাদী ও অন্যদের সহযোগিতায় আমাকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। যেহেতু মামলাটি তদন্তাধীন, তাই এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।’