অসন্তোষের মৌসুম

তীব্র কায়িক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের চাপ শেষে সম্পূর্ণ কর্মহীন সময় পার করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবু জীবনের প্রতিটি পর্যায় কাজ এবং ক্লান্তি বা অদক্ষতার কারণে দীর্ঘ সময় কর্মহীনতায় পরিপূর্ণ থাকে। আর সে জন্য অনেক সময় আমাদের চড়া মূল্য চুকাতে হতে পারে। সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমার নিজের সংগ্রামকে পর্যালোচনা করে একটি আচরণগত প্যাটার্ন দেখতে পেয়েছি। আমার মনে হয়, এর সঙ্গে আরও অনেকেই নিজের মিল খুঁজে পাবে।

বিলম্ব করার প্রবণতা নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার আতঙ্ক নিয়ে একটি স্থায়ী উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। আমার বেলায় এই আত্মোপলব্ধিই চূড়ান্ত কোনও সান্ত্বনা নয়। কেননা, আমি বুঝে গেছি, এসব ঘটনাচক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আমার আসক্তি এবং একসঙ্গে একাধিক কাজ করার প্রতিশ্রুতি সরাসরি যুক্ত। দক্ষতা নিয়ে নিজের প্রতি আমার আস্থা কিছুটা নড়বড়ে হয়ে যায় যখন আমি আবিষ্কার করলাম, কাজ নিয়ে গড়িমসি করার এই দুষ্ট চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না!

আমি প্রায়ই ভাবি, কোনটি সবচেয়ে বড় সমস্যা—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিজেই নাকি আমাদের এর থেকে সরে আসতে পারার অক্ষমতা? নাকি একটি কাজে মনোযোগ না দিয়ে একসঙ্গে একাধিক কাজে নিজেকে মেলে ধরার ক্লান্তি?

এমনকি আমরা এমন একটি সমান্তরাল ভার্চুয়াল জগতে বাস করছি, যেখানে আমরা এবং অন্য সবাই প্রধান চরিত্র। পুরনো দিনে আনন্দ নিয়ে টেলিভিশন দেখা, সিনেমা দেখা, গান শোনা অথবা পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এখন ভার্চুয়াল এই জগতে আমরাই সেই অভিনেতা, যে নিজে কতটা বড়, কতটা খ্যাতিমান তা মানুষকে দেখিয়ে বেড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। এখানে ‘দেখা’র বা নিজেকে ‘দৃশ্যমান’ করার প্রবল আকুতি রয়েছে।

একবার জনৈক এক ব্যক্তি বলেছিলেন, একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের বিচরণ মানুষের মধ্যে থাকা দুটি সাধারণ আবেগের বৈধতা দেয়। তা হলো নার্সিসিজম বা নিজের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা এবং ভয়ারিজম বা যৌনতা নিয়ে চরম অনুসন্ধিৎসা।

সাম্প্রতিক একটি খবরে আমার চোখ আটকে যায়; ইলন মাস্কের স্টারলিংক ৯৯টিরও বেশি দেশে ৩০ লাখ গ্রাহককে যুক্ত করেছে। এমনকি প্রথমবারের মতো অ্যামাজন রেইনফরেস্টের প্রত্যন্ত গ্রামেও তারা প্রবেশ করেছে। সেখানে রেইনফরেস্টের উপজাতিরা এখন শুধু ডিজিটাল ভুল/তথ্য, ভিডিও গেমস, অন্যান্য গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ, সিনেমা দেখা ইত্যাদি অ্যাক্সেস পাচ্ছে।

নতুন এই প্রযুক্তির অনুপ্রবেশকে জীবিকার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করছেন শিকার করা এবং মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল কিছু সম্প্রদায়ের প্রবীণরা। উপজাতি নেতারা তাদের পুরুষ ও যুবকদের মধ্যে অলসতার প্রভাব আবিষ্কার করেছেন। দৈনন্দিন কাজ শেষ করা নিশ্চিত করার জন্য ইতোমধ্যে তারা সীমিত সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন।

আমি ভাবছি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন পরিস্থিতি আরোপ করা হলে কী ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে? নিঃসন্দেহে একটা বিশাল হইচই শুরু হয়ে যাবে। কেননা, মানুষ এখন দুর্বল ওয়াইফাই সংযোগের স্থানে থাকতেই চায় না!

অধিকাংশ মানুষের জন্যই এটি হবে একটি চুক্তি ভঙ্গ করার মতো বিষয়। যেহেতু প্রায় সবাই এখন তাদের নিউজফিড ও মেসেজের একাধিক প্ল্যাটফর্মগুলো বারবার চেক করা এবং সেগুলোতে আপডেট দেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে আমাদের জীবনের ঘণ্টাগুলো কিন্তু অফুরন্ত নয়। যদিও সময় অপচয় নিয়ে আমরা কদাচিৎ নিজেদের দায়ী করে থাকি। তবে স্বল্পমেয়াদি পরিতৃপ্তির জন্য এই ধরনের অযৌক্তিক বিভ্রান্তিতে ব্যয় করা ঘণ্টাগুলোকে আমরা যদি যুক্ত করি, তবে তা নিতান্তই আমাদের গভীরভাবে ভাবাতে পারে।

কেউ কি খেয়াল করে দেখেছেন, কীভাবে দীর্ঘ ভিডিও (binge watching) বাদ দিয়ে আমাদের ছোট ছোট ভিডিও (binge reeling) দেখার প্রবণতা বাড়ছে? তবে ‘binge reeling’ শব্দটি এখন আর প্রচলিত নয়। আমার জেন জেড (১৯৯৭-২০১২ সালের মধ্যে যাদের জন্ম) কন্যা সংশোধন করে বলেছে, এটিকে এখন ‘ডুম স্ক্রলিং’ বলা হয়।

আমাদের নেটওয়ার্কের মধ্যে বন্ধুরা সবসময় মজার মজার রিল শেয়ার করে থাকে এবং সেগুলো দেখার সময় মনের অজান্তেই অনিবার্যভাবে আমরা আরও রিল দেখতে নিচের দিকে স্ক্রল করতেই থাকি। এরপর নতুন রিলগুলোকে ভিন্ন বা একই বন্ধুদের সঙ্গে আবারও শেয়ার করি! আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, রিলটি যদি বিশ সেকেন্ডের বেশি হয় (আমার ভুলও হতে পারে) এটিকে আমাদের কাছে বেশ দীর্ঘ বলে মনে হয়। তবে আমরা যখন এই নিরবচ্ছিন্ন বিনোদনে মগ্ন থাকি তখন আবার এই আবেশে কত ঘণ্টা নষ্ট হলো তা খুব কমই খেয়াল করে থাকি। একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বা শো দেখা আমাদের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ এতে ‘অত্যধিক’ সময়ের সঙ্গে গভীর মনোযোগও দিতে হয়। তাই এর চেয়ে মানুষ বরং রিল বেশি উপভোগ করে। এই অভ্যাসটি আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার সময়কে খুব প্রভাবিত করছে, যা মস্তিষ্কের ক্লান্তির জন্যও দায়ী।

সাম্প্রতিক সময়ে কোনও কিছু অর্জনের পরে আমাদের তৃপ্তির অনুভূতির সময়কাল কীভাবে সংক্ষিপ্ত হয়েছে তা কি আমরা কখনও খেয়াল করেছি? বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তারা সবসময় জোর দিয়ে বলেন, সফল হতে হলে কখনও আত্মতুষ্ট হওয়া উচিত নয়। তবে আমি মনে করি, আমাদের এখনও ছোট ছোট বিজয়ের খ্যাতি উপভোগের অধিকার রয়েছে। অন্তত আজকের এই ভার্চুয়াল জগতে এটি খুবই স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একইসঙ্গে আমাদের নেটওয়ার্কে আমরা এ ধরনের অর্জন প্রচারও করে থাকি। তবে এই অনুভূতি আসলে কতক্ষণ স্থায়ী হয়? একটি পোস্ট শেয়ার করার পর অন্তত শতাধিক (আমার জন্য যথেষ্ট ভালো সংখ্যা!) লাইক বা ভালোবাসা অর্জন করার এক বা দুদিনের মধ্যেই আমরা খারাপ লাগার আবেশে ভাসতে থাকি। কেন আমাদের সুখ-দুঃখ এত ক্ষণস্থায়ী? আমার মনে হয়, এটি আবারও সেই অন্য মানুষদের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখার সঙ্গেই সম্পর্কিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সময়ের আগে আমাদের প্রতিদিনের মিথস্ক্রিয়া শুধু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নেটওয়ার্ক প্রাধান্য পাওয়ায় একই মিথস্ক্রিয়া অনেক এবং আরও অনেক মানুষের সঙ্গে ঘটছে। ফলে আমাদের মননের জন্য সামান্যই সুযোগ থাকছে।

অন্য আরেক ধরনের সন্তুষ্টির উদ্ভব হয় আমাদের সামাজিক গণ্ডির ভিতরে ও বাইরের বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনধারা দেখে। ফলে ক্রমাগতই আমাদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় সম্পত্তি অর্জনের লোভ জন্মায়। আগের প্রজন্ম কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পাওয়া জীবনের অর্জনগুলো থেকে তৃপ্তির গভীর অনুভূতি উপভোগ করতো। তবে উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রতিযোগিতায় না নামাটাকে এখন পিছিয়ে পড়া হিসেবে দেখা হয়। তবে ঠিক কতটা প্রতিযোগিতা হলে তা যথেষ্ট মনে করা হবে কেউ কি সংখ্যাগতভাবে তা নির্ধারণ করতে পারে?

উইন্ডসরের ডাচেস ওয়ালিস সিম্পসন একবার বলেছিলেন, ‘আপনি কখনোই খুব গরিব বা খুব ধনী হতে পারবেন না’ এবং ভার্চুয়াল জগতে এই কথাটা যেন আক্ষরিক অর্থেই খাটে। এখানে লজ্জাজনক পরিস্থিতি এড়াতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই একটি অলিখিত অথচ নির্দিষ্ট উপায় মেনে চলতে হবে; তাদের যেন নিজ নেটওয়ার্কের মধ্যে অন্য সবার চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক হতেই হবে, তাদের এমন স্থানে ছুটি কাটাতে যেতে হবে যেটি অন্যদের জন্য সাধ্যের বাইরে বলে মনে হবে। এই তালিকাটি আসলে অসীম।

আমার সত্যিই মনে হয়, আমরা  যেন শুধু আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভালো পোস্ট দেওয়ার জন্যই বেঁচে আছি এবং এই কাজগুলো করছি। আমরা কি সত্যিই এসবের কিছু অনুভব করতে পারছি, নাকি কেবল আমাদের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করে যাচ্ছি? এখানে এমনকি সবচেয়ে লাজুক ব্যক্তিটিও নিজেকে বহির্মুখী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে।

অনর্থক ও অবিবেচক এবং অস্বাস্থ্যকর ট্রলিংয়ের প্রতি আমরা আকর্ষণবোধ কেন করি? পুরনো বিশ্বে যে শালীনতার দিন ছিল—যখন মানুষেরা কঠোর মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকতো; তা এখন আর নেই। তবে এখন আতঙ্ক, হুমকি, কালিমা লেপন, অপমান ও ধমকের মতো বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মের ওপর মানসিক প্রভাব ফেলছে। আমরা কি তাদের মানুষদের কাছ থেকে আসা এ ধরনের বিষাক্ত মন্তব্যের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করেছি,  যারা তাদের জীবনে  গুরুত্বপূর্ণ কোনও ভূমিকা পালন না করা সত্ত্বেও তাদের মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম?

ভার্চুয়াল জগতে সম্ভাবনা কম বলতে গেলে আসলেই কিছু নেই। বরং সেটি আমাদের দিগন্তকে সীমাহীন সম্ভাবনায় প্রসারিত করেছে। এই সম্ভাবনাকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করতে হলে নিজেদের আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে এই জগৎ যেভাবে আমাদের জীবনকে কব্জা করে রেখেছে তা রুখতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। এখনও এমন অনেক মানুষ আছেন যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি অ্যাকাউন্ট না খোলার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিজেকে বাহবা দেয়। আর এই সিদ্ধান্ত তাদের সময়কে আরও উৎপাদনশীলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো সমৃদ্ধির পথে সর্বশ্রেষ্ঠ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তবে একইসঙ্গে এটি তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি পাওয়ার একটি প্রবণতাও তৈরি করছে, যার পরই রয়েছে প্রত্যাহারের ও অসন্তোষের বিরামহীন অনুভূতি। সমাজবিজ্ঞানীদের এই চক্রটি ভাঙতে এবং এর প্রতিকারে সচেতনতা তৈরি করতে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় থাকার একটি সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। আমাদের সুখানুভূতি সবসময় ক্ষণস্থায়ী হবে আমরা যদি আমাদের চারপাশে যা আছে সেগুলোর স্পর্শ, স্বাদ ও গন্ধ নিতে, শুকতে, শুনতে এবং দেখতে ব্যর্থ হই। জীবনে চলার পথে কোনও শর্টকাট নেই এবং শেষ পর্যন্ত  আমাদের একে অপরের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতি ভাগ করার মাধ্যমেই জীবনকে অতিবাহিত করতে হবে। খুব কম মানুষেরই মহৎ হওয়ার সৌভাগ্য হয়। তবে এটি যেন আমাদের তৃপ্ত হওয়ার অনুভূতিটাকে কেড়ে নিতে না পারে। কেননা, এটিই পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের প্রকৃত সারমর্ম।

লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।