ঢাকার ১৪ হাসপাতালে ১৬৮ মরদেহ

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সংঘাতে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এর মধ্যে ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি ১৪টি হাসপাতাল ঘুরে ১৬৮টি মরদেহ আসার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তারা গত ১৬ জুলাই থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি হন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীতে সংঘর্ষ-সংঘাত প্রথম দিকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর গত ১৭ আগস্ট থেকে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার কয়েকটি প্রান্তে। সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে উত্তরা-আব্দুল্লাহপুর, বাড্ডা-রামপুরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া, মোহাম্মদপুর-বছিলা এবং ধানমন্ডি সায়েন্সল্যাব, নিউমার্কেট এলাকায়।

সংঘর্ষে আহত ব্যক্তিরা আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত অবস্থায় অনেককে নিয়ে আসা হয়। তাদের বেশির ভাগরই তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন একাধিক হাসপাতালের কর্মকর্তারা। আবার কিছু হাসপাতাল তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে।

সরকারি হাসপাতালগুলোর তথ্য
ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মৃতের সন্ধান পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন ৯৮ জন, এর মধ্যে ৯৭ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির উপপরিচালক আশরাফুল আলম।

এ ছাড়া আজ সোমবার (২৯ জুলাই) ঢামেক হাসপাতালে মো. বাবুল হাওলাদার (৪৮) নামে আরও একজনের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। ২১ জুলাই থেকে তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ঢামেক কর্তৃপক্ষ।

সংঘাতে কয়েক শ আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জরুরি বিভাগ এবং মর্গে কথা বলে জানা যায়, সংঘাতে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে চার জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। তাদের সবাইকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এর মধ্যে দুজনের মরদেহ তার সঙ্গে আসা ব্যক্তিরা জোর করে হাসপাতাল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। বাকি দুজনের মরদেহ হাসপাতালের ফরেন্সিক বিভাগের মর্গে রাখা আছে।

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৩টি মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছিল বলে বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান। তিনি জানান, তাদের সবাইকেই মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। পরিস্থিতির কারণে ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে তাদের নাম-পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) দুটি মরদেহ নিয়ে আসার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তাদের বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ছয় জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে মৃতদের বিস্তারিত তথ্য দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, এসব ব্যাক্তি সংঘাত সংঘর্ষের মধ্যেই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল।

রাজধানীর উত্তরায় কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে সংঘর্ষে নিহত আট জনের মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছিল। তবে সেসব মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক মিজানুর রহমান।

বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব হাসপাতালের কিছু তথ্য বাংলা ট্রিবিউন সংগ্রহ করতে পেরেছে।  

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালে দুজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। গত ১৯ জুলাই তাদের দুজনকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। পরদিন ২০ জুলাই তারা মারা যান। তাদের একজনের বয়স ১৫ বছর এবং অন্যজনের ৩৪। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. মঈনুল আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এ ছাড়া ধানমন্ডি এলাকার পপুলার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল ঘুরে আহতদের তথ্য পাওয়া গেলেও এসব হাসপাতালে কোনও মরদেহ আসার ঘটনা নেই বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টরা।

উত্তরা এলাকার কিছু হাসপাতালের তথ্য পাওয়া গেছে। উত্তরায় সবচেয়ে বেশি হতাহতের চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এই হাসপাতালে প্রচুর আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন। সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে এখানকার চিকিৎসকদের।

হাসপাতালের উপপরিচালক মেজর (অব.) মো. হাফিজুল ইসলাম জানান, ১৮ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে ১১টি মরদেহ এখানে এসেছে। তাদের সবার তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।

উত্তরা এলাকার অন্যান্য হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লুবানা জেনারেল হাসপাতাল ও কার্ডিয়াক সেন্টারে একটি মরদেহ নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া শিন-শিন জাপান হাসপাতালে দুটি মরদেহ নিয়ে আসা হলেও সেগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করা হয় বলে জানিয়েছে হাসপাতালের প্রশাসনিক বিভাগ। পাশাপাশি উত্তরা ক্রিসেন্ট হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই পাঁচটি মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছিল বলে হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

রাজধানীর মিরপুরে সংঘর্ষের ঘটনায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদকরা এ সময় সেসব এলাকায় উপস্থিত ছিলেন। ১৯ জুলাই বিকালের পর মিরপুরের পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটলে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক মিরপুর ১০-এর ফায়ার সার্ভিসের পশ্চিম পাশে থাকা ডা. আজমল হাসপাতালে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি আটটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।

একই এলাকার আলোক হাসপাতালে ছয়টি মরদেহ আসার ঘটনা দেখেছেন এই প্রতিবেদক। তবে পরদিন থেকে কোনও মরদেহ গ্রহণ করেনি এই দুটি হাসপাতাল। তাদের দাবি, গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে নিয়ে আসা হলেও তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ অন্যান্য জায়গায় স্থানান্তর করা হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত হয়েছেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজ। গত ১৮ জুলাই তিনি মোহাম্মদপুরে সিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।