পিঠে-পেটে-পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তারা

চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকার দারুত তারবিয়াত মাদ্রাসার শিক্ষক মো. ওসমান (৩৫) ১৮ জুলাই মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন। ওই সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে যান। এতে একাধিক ছররা গুলি এসে তার পিঠে বিদ্ধ হয়। আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হন। সেদিন থেকে হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখনও গুলির ক্ষত শুকায়নি। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

চমেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ওসমানের মতো গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন বেডে চিকিৎসাধীন আছেন নয় জন। গুলি লেগেছে কারও পেটে, কারও পিঠে আবার কারও পায়ে। কারও লেগেছে দুটি গুলি, কারও লেগেছে তিনটি আবার কারও লেগেছে পাঁচ-ছয়টি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।

চমেক হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার সময়ে আহত হয়ে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে ৪০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জন চোখের সমস্যায় ভুগছেন। ক্ষত কিছুটা শুকানোর পর তাদের চক্ষু বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে।

হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে চিকিৎসাধীন ওসমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাচ্ছিলাম। এ সময় পুলিশের তাড়া খেয়ে আন্দোলনকারীরা দৌড়াতে থাকে। আমি তখন ষোলশহরের শুলকবহর গলিতে ছিলাম। দৌঁড়ায়নি, কারণ আন্দোলনে আমি নেই। পাঞ্জাবি পরা ছিলাম। পুলিশ মাত্র ৫-৬ হাত দূর থেকে আমাকে গুলি করেছে। সব গুলি পিঠে এসে লেগেছে আমার।’

তিনি বলেন, ‘আমি যদি কোনও অপরাধ করতাম তাহলে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতো। আন্দোলনে সম্পৃক্ততা পেলে শাস্তি দিতো। এভাবে কোনও কারণ ছাড়া আমাকে পুলিশ কেন গুলি করলো, বুঝতে পারলাম না।’

একই হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরমান হোসেন (১৭), মো. আকাশ (১৮) ও মো. রুবেল (২২)। অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন ইয়াস শরীফ খান (১৭), মো. আবুল বাশার (২৮), মো. সুজন (১৪) ও নাজমুল হোসেন (২৪)। চক্ষু বিভাগে চিকিৎসাধীন আছেন আমিরুল ইসলাম আরিফ (২২) নামে এক শিক্ষার্থী।

চিকিৎসাধীন মো. আকাশ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নগরীর মুরাদপুরে একটি গ্যারেজে কাজ শিখছি আমি। হামজারবাগ সংগীত এলাকার বাসা থেকে ১৬ জুলাই দুপুরে ভাত খেয়ে গ্যারেজে যাচ্ছিলাম। মুরাদপুরে সড়কে ওঠার পরই গুলিবিদ্ধ হই। আমার পেটের ডান পাশে দুটি গুলি লেগেছে। ওই দিন হাসপাতালে ভর্তি হই। ইতোমধ্যে দুবার অপারেশন হয়েছে। কবে নাগাদ সুস্থ হবো, তা জানাতে পারছেন না চিকিৎসকরা।’

১৮ জুলাই নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় ১৪ বছরের কিশোর মো. সুজন। তার বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। এতে হাড় ভেঙে গেছে। হাসপাতালে সুজনের পাশে বসে আছেন মা নুরুন্নাহার বেগম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট সুজন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এ কারণে লেখাপড়া করাতে পারিনি। কারখানায় কাজ করতে দিয়েছি। ঘটনার দিন দুপুরে চান্দগাঁও এলাকা থেকে ভাত খেতে বহদ্দারহাট খাজা রোডের বাসায় আসছিল। এ সময় পায়ে গুলি লাগে। পায়ের এক্স-রে করিয়েছি। চিকিৎসকরা বলেছেন, পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। আমার মতো গরিব মানুষ কীভাবে ছেলের চিকিৎসা খরচ বহন করবো বুঝতেছি না। ইতোমধ্যে ধারদেনা করে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।’

অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন আবুল বাশার পেশায় ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী। ১৮ জুলাই বহদ্দারহাট এলাকায় ভ্যানে করে আম বিক্রি করছিলেন। সংঘর্ষের সময় পা, বুক ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। গুলিতে ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। আবুল বাশারের স্ত্রী হাফসা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বহদ্দারহাটে সংঘর্ষ শুরু হলে দোকান গুছিয়ে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় তার পা, বুক ও মাথায় পাঁচটি গুলি লাগে। আমার স্বামী কোনও দলের রাজনীতি করে না। যখন যেসব ফলের মৌসুম তা ভ্যানে করে বিক্রি করে আসছিল। আমের মৌসুম শুরুর পর থেকে আম বিক্রি করছিল। তার আয়ে কোনোমতে আমাদের সংসার চলে। গত ১০ দিন ধরে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। চিকিৎসা খরচ নিয়ে বেকায়দায় আছি।’ 

ইয়াস শরীফের বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। তারও পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। ইয়াস এবার এসএসসি পাস করে গত ১৬ জুলাই নগরীর ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। তবে কলেজে এখনও ক্লাস শুরু হয়নি। নগরীর হালিশহরের আনন্দবাজার এলাকায় তাদের বাসা। ইয়াসের বাবা এজাজ খান বলেন, ‘আমাকে না বলে কখন যে আন্দোলন দেখতে চলে গিয়েছিল জানতাম না। এক মাস আগে তার মা মারা গেছে। এরই মধ্যে ছেলেটা গুলিবিদ্ধ হলো। আমি নিজেও অসুস্থ। আমার হার্টে রিং পরিয়েছি। আমার যেন একটার পর একটা বিপদ লেগেই আছে। চিকিৎসকরা বলেছেন তার পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। কী করবো, আমি বুঝতে পারছি না।’ 

ইয়াস শরীফ বলেন, ‘আমি আন্দোলন করিনি। সেদিন দেখতে গিয়েছিলাম। কখন যে পায়ে গুলি লেগেছে বুঝতে পারিনি। পরে রক্ত ঝরতে শুরু করলে টের পাই। আমি আগের মতো ভালো হবো তো? হেঁটে কলেজে যেতে পারবো তো’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

চক্ষু বিভাগে চিকিৎসাধীন আমিরুল ইসলাম আরিফ কক্সবাজার সরকারি কলেজের ছাত্র। কক্সবাজারে সংঘর্ষে আহত হন। তার চোখে ছররা গুলি লেগেছে। এতে চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক জানিয়েছেন। আরিফ বলেন, ‘আমি ডান চোখে কিছুই দেখছি না। ইতোমধ্যে একবার অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, আরও অপারেশনের প্রয়োজন হবে। কিন্তু চোখ ভালো হবে কিনা তারা বলতে পারছেন না।’ 

চমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সৌমেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংঘর্ষে আহত ৩০ জনের বেশি আমাদের বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। বেশিরভাগই ছাড়পত্র নিয়ে গেছেন। গুরুতর আহত কয়েকজন এখনও চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ।’

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘কোটা আন্দোলনে সংঘর্ষে আহত দুইশ’র বেশি মানুষ এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের চার জনই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। আহত অবস্থায় আরেকজনকে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা গেছেন। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ছয় জনের মৃত্যুর খবর জানি আমরা।’

মাদ্রাসাশিক্ষক মো. ওসমানের পিঠে একাধিক গুলি লেগেছে

চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালের এমডি ডা. রেজাউল করিম বলেন, ‘আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ আরিফুল ইসলাম নামে একজন এখনও আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অপারেশন হয়েছে। বর্তমানে শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। আমাদের এখানে কারও মৃত্যু হয়নি।’

গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। নগরীর মুরাদপুর এলাকায় এই সংঘর্ষ শুরু হলেও তা ছড়িয়ে পড়ে বহদ্দারহাট থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত। পরদিন একই এলাকার কয়েক কিলোমিটারজুড়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১৮ ও ১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের আবারও সংঘর্ষ হয়। পুলিশকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এতে ছয় জনের মৃত্যু ও শিক্ষার্থীসহ দুই শতাধিক মানুষজন আহত হন।