‘হাড্ডি নেই, চাপ দেবেন না’

ব্যান্ডেজে মোড়ানো পুরো মাথা। সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড্ডি নেই, চাপ দেবেন না।’ এই দৃশ্য দেখা গেছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন এক যুবকের। তার নাম মো. সোহেল। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অবস্থা আশঙ্কাজনক।

গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় একটি ছয়তলা ভবন থেকে ছাত্রলীগের ১৫ কর্মীকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন সোহেল। গুরুতর আহত হওয়ার পর থেকে আইসিইউতে আছেন। প্রথমে চট্টগ্রাম পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তার সঙ্গে একই ঘটনায় আহত আরও দুজনকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

রবিবার (২৮ জুলাই) বিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সোহেলসহ বাকিদের খোঁজখবর নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

চিকিৎসক ও স্বজনরা জানিয়েছেন, সোহেলের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়; সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছেন। মাথায় এত বেশি আঘাত লেগেছিল, যার কারণে খুলি খুলে রেখেছেন চিকিৎসকরা। খুলিটি বর্তমানে ফ্রিজে রাখা আছে। পুরো মাথা ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। শনিবার জ্ঞান ফিরলেও কথা বলতে পারছেন না।

সোহেল নগরীর বাকলিয়া থানার শান্তিনগর বগারবিল এলাকার মৃত আবদুল নুর ভূঁইয়ার ছেলে। তার বড় ভাই মো. কামাল ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সোহেল সবার ছোট। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। বড় মেয়ে সানজিদা আকতার (৯) এবং দুই ছেলে ইয়াসিন (৬) ও ইয়াকুব (৪)। তারা বাবার জন্য কাঁদছে। স্ত্রী জোহরা বেগম ঘটনার পর থেকে বাকরুদ্ধ। স্বামীর চিন্তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’

সোহেলের অপারেশন হয়েছে, ১০ দিন পর গত শনিবার জ্ঞান ফিরেছে উল্লেখ করে কামাল ভূঁইয়া বলেন, ‌‘এখনও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছে। ডাকলে চোখ মেলে তাকায়। আবার বন্ধ করে ফেলে। কোনও কথাবার্তা বলতে পারছে না। চিকিৎসকরা বলেছেন, স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে। যারা আমার ভাইয়ের এমন অবস্থা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি আমরা।’

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের বিষয়ে কামাল বলেন, ‘সে সংঘর্ষে জড়ায়নি। যুবলীগের রাজনীতি করতো। কোনও পদে ছিল না। ক্ষোভ থেকে ছাত্র নামধারী কয়েকজন ব্যক্তি ছয়তলা থেকে ফেলে দিয়েছিল।’ 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংঘর্ষ চলাকালীন ১৬ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে মুরাদপুরের বেলাল মসজিদ সংলগ্ন ছয়তলা ভবন ‘মীর মঞ্জিলের’ ছাদে আশ্রয় নেওয়া ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীকে বেধড়ক পিটিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় কয়েকজন কর্মী ছাদ থেকে ভবনের পাইপ বেয়ে নিচে থামতে গেলেও পেটানো হয়। এতে কয়েকজন নিচে পড়ে যান। আরও কয়েকজনকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা সোহেলসহ ১৫ কর্মীকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিল বলে অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতাদের।

এর মধ্যে ১২ জন চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। তবে সোহেলসহ তিন জনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। বাকি দুজন হলেন চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ শাখার ছাত্রলীগ নেতা জালাল উদ্দিন জোবায়ের এবং চট্টগ্রাম কলেজ ইতিহাস বিভাগের ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক মো. ইকবাল হোসেন। এই তিন জন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী। বাবর সাবেক কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক। 

এ প্রসঙ্গে হেলাল আহবর চৌধুরী বাবর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা করেছে। তাদের হামলায় আমাদের ৫৪ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এর মধ্যে তিন জনের অবস্থা গুরুতর। তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বাকিদের চট্টগ্রামে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।’

ঘটনার দিন ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা ছয়তলা ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিল উল্লেখ করে বাবর আরও বলেন, ‘জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাদের ১৫ জনকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে ছয়তলার ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিল। শুধু ফেলে দিয়েই থামেনি তারা, নিচে পড়ার পর পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। মারা গেছে ভেবে ফেলে রেখে যায়। আমি এই হামলাকারীদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’

আহত তিন জনের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে বাবর বলেন, ‘সবার অবস্থা গুরুতর। রবিবার প্রধানমন্ত্রী দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন। খোঁজখবর নিয়েছেন। চিকিৎসায় যাতে কোনও ধরনের ত্রুটি না নয়; সে বিষয়ে চিকিৎসকদের নির্দেশনা দিয়েছেন।’

মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া উপকমিটির সদস্য নুরুল আজিম রনি বলেন, ‘ঢাকায় চিকিৎসাধীন তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর মধ্যে সোহেলের মাথায় এত বেশি আঘাত করেছে হামলাকারীরা, যার কারণে খুলি খুলে রাখতে হয়েছে। মাথায় খুলির স্থলে ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে অপারেশন হয়েছে। এখনও কথা বলতে পারছে না। চিকিৎসকরা বলেছেন খুলিটা বসাতে অন্তত তিন মাস লাগবে। বর্তমানে মাথার খুলি বিশেষ ব্যবস্থায় ফ্রিজে রাখা হয়েছে।’

বাকি দুজনের অবস্থা সম্পর্কে রনি বলেন, ‘ইকবালের কোমর ভেঙে গেছে। তারও অপারেশন হয়েছে। ভেঙে যাওয়া স্থান জোড়া লাগানো হয়েছে। জোবায়েরের শরীরের ২৩ স্থানে জখম হয়েছে। ডান পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। চিকিৎসকরা বলেছেন তাদের সুস্থ হতে সময় লাগবে।’

চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মনিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোহেল নগর যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং সক্রিয় কর্মী। জুবায়ের মহসিন কলেজ শাখা এবং ইকবাল চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের ওপর হামলা করেছিল জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি-পিআর) কাজী মোহাম্মদ তারেক আজিজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছাদ থেকে ফেলে ছাত্রলীগ কর্মীদের আহত করার ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় ২৭ জুলাই মামলা হয়েছে। ওই ঘটনায় আহত এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। মামলায় ৫০ জনের নাম উল্লেখসহ ৩০-৩৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।’