গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তারা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন (৫ আগস্ট) কোটা সংস্কার আন্দোলনে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-সংঘর্ষ, পুলিশের ছররার গুলিতে আহত হয়ে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ৭৪ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৪৩ জন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৩১ জন। গত সোমবার (১৯ আগস্ট) বিকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের নতুন ভবনের চার তলায় (চক্ষু বিভাগ) ছররার গুলির যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ৮ জন আন্দোলনকারী।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তিনজন গুরুতর আহত আন্দোলনকারীকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহতরা হলেন, আল-আমিন (১৮), শোভন (৪২) ও শাওন (২০)।

আহতদের মধ্যে খোকন ইসলাম (২৮) জানান, আমার বাবা আজির উদ্দিন পৃথিবীতে বেঁচে নাই। চার ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয় আমি। পুরো পরিবারের ভরণপোষণ আমাকে চালাতে হয়। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের শটগানের ছররার গুলিতে আহত হয়ে ১৫ দিন যাবত শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছি কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ সহমর্মিতা জানাতেও এলো না। দুঃখ হলেও সত্য যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলো, নতুন বাংলাদেশ তৈরি হলো, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলো কিন্তু আমাদের কেউ খবর নিলো না।

একই ওয়ার্ডের সৌমিক হাসান সোহাগ (১৮) উচ্চ মাধ্যমিকে ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী জানান, ‘আন্দোলন করে গুলি খেয়ে আহত হয়ে এখন হাসপাতালের বিছানায় মরণযন্ত্রনা ভোগ করছি। নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠিত হলো। তবে ১৫ দিনেও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ খোঁজ-খবর নিতে এলো না। নেই প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। এখন বাবা-মা ছাড়া বিপদে পাশে কেউ থাকে না।’

নীলফামারী পৌর শহরের কুখাপাড়া মহল্লার সামিম হোসেনের ছেলে সোহাগ বলেন, ‘দুই ভাই, দুই বোন, বাবা ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী। কিছুদিন আগে বাবা স্ট্রোক করেছে। তার বড় ছেলে হিসেবে আমিও হাসপাতালে। বাবার চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছি না। বর্তমানে অভাব-অনটনে আমাদের দিন পার হচ্ছে। তিনি বলেন, নেতারা দল বদলের আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত। আমরা কি খাচ্ছি, কি করছি কেউ তার খবর রাখে না।’

সোহাগ ও খোকনের মতো বুলবুল ইসলাম (৩৬), রেজাউল ইসলাম (২৬), রানা ইসলাম (১৯), সাকিল হোসেন (২৭), মুন্না (২০) অভিযোগ করে বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকালে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে নীলফামারী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হই। আমাদের মতো গুলিবিদ্ধ আরও ৪৩ জনের মধ্যে অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে, কিন্তু আমরা গুরুতর গুলিবিদ্ধ হওয়ায় হাসপাতালে দিন কাটছে। কবে বাড়ি ফিরতে পারবো জানি না। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা আমাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের দেখার কেউ নেই।’

গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আরেক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সাকিল হোসেন জানান, ‘আমাদের চাপের মুখে দুই দিন আগে (১৮ আগস্ট) আমাদের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আলাদা ওয়ার্ডসহ বিনামূল্যের সব ব্যবস্থা করেছে। তিনি জানান, যাদের দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হবে, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সরকারকে সকল চিকিৎসার দায়ভার নেওয়ার অনুরোধ জানাই।’

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. আব্দুর রহিম জানান, ৫ আগস্ট বিকাল থেকে আহত শিক্ষার্থী ও জনতা ভর্তি হতে থাকে। সেদিনেই ৩১ জন প্রাথমিক সেবা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। আর বাকি ৪৩ জন এখানে সেবা নেন। এখন অধিকাংশই সুস্থ। চিকিৎসাধীন ৮ জনকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে ৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আগে ও পরে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন, গুরুত্ব সহকারে চিকিৎসাসহ তাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স এবং কর্মচারীরা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছেন। বিনামূল্যে ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা তাদের দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তিনি বলেন, বাকি যারা এখনও হাসপাতালে ভর্তি, তাদেরকে বিনামূল্যে সুচিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’