ঢাকা নিয়ে দিল্লি-ওয়াশিংটনের ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন

বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের ভিন্নতা কোনও গোপন বিষয় নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার ভারতকে সতর্ক করে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু গত তিন সপ্তাহে এই অবস্থানের ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়েছে।

এখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু তথা হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে– এ বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অভিযোগ করছে ভারত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে সোমবার (২৬ আগস্ট) এক ফোনালাপের পর দিল্লি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দুই নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং আইনশৃঙ্খলা পুনপ্রতিষ্ঠা করা ও সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের, নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছেন।

অবশ্য ওই ফোনালাপ নিয়ে একই দিন ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ বিষয়টির কোনও উল্লেখ ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ভারতের কাছে যেটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভারত স্বস্তিকর অবস্থায় ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল। অন্যদিকে এখন দিল্লি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং পশ্চিমা বিশ্বে স্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে। মোটাদাগে সমীকরণ উল্টে গেছে।’

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ
দুই দেশের মধ্যে যখন রাজনৈতিক আলাপ হয়, তখন দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের পাশাপাশি উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। তবে উভয় দেশের একটি অভিন্ন অবস্থান না থাকলে, তৃতীয় দেশ নিয়ে আলোচনা সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। যেমন বাইডেন-মোদি ফোনালাপের পর উভয় দেশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউক্রেন ইস্যুতে কথা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু শুধু ভারতের সংবাদ বিজ্ঞপিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি এসেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, ‘প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের যে স্বার্থ, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের থেকে অনেক গুণ বেশি। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারতের নিরাপত্তা, পানিবণ্টন, মানুষে মানুষে যোগাযোগসহ বিভিন্ন স্বার্থ রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য নয়। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া অন্য যেকোনও দেশের থেকে বেশি হবে, এটিই স্বাভাবিক এবং সেটির প্রতিফলন হচ্ছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এককভাবে বাংলাদেশের বিষয়টি উল্লেখ করা।’

ভারতের কূটনীতি
দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্কের পাশাপাশি মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা বা নেপালের সঙ্গেও বিভিন্ন সময়ে ভারতের সম্পর্কের অবনতি দেখা গেছে। এই অঞ্চলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের কূটনীতিতে একমাত্র সফল উদাহরণ ছিল বাংলাদেশ এবং সেটিরও অবনতি হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর।

এ বিষয়ে আরেক সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বা অন্য অস্থিরতা ছিল এবং তখন ভারতের অবস্থান ছিল– এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের পর ভারত প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের প্রকাশ্যে উদ্বেগ তাদের সংবাদমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। কিন্তু ভারত যদি প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ না করতো, তবে হয়তো সংবাদমাধ্যম ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতার খবর অধিক হারে ছাপা হতো।’

বার্তা দিচ্ছে দিল্লি
দীর্ঘদিন বাংলাদেশের ক্ষমতায় যারা ছিল, তাদের সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভারত এবং ভিন্ন কোনও পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি দিল্লি। ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে একধরনের শূন্যতার মধ্যে রয়েছে ভারত।

এ বিষয়ে আরেক সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘প্রকাশ্যে উদ্বেগ জানানোর মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে তারা বার্তা দিচ্ছে যে দিল্লি এখনও তাদের পাশে আছে।’