নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করতে চায়, তবে…

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর যেসব প্রতিষ্ঠান সংকটে রয়েছে তার মধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) অন্যতম। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির চালকের আসনে থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ চার কমিশনার পদত্যাগের জন্য এক ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তবে, তারা সরকারের বার্তার অপেক্ষায় রয়েছেন। নিজেদের অবস্থান ও করণীয় জানতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য, সরকারের সাড়া না পেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখে সরকার বা জনগণকে তাদের নিজেদের অবস্থান জানানোর চেষ্টা করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পরদিন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল, কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব, মো. আলমগীর, বেগম রাশিদা সুলতানা দফতরে উপস্থিত ছিলেন। এ দিন কমিশনার আনিসুর রহমান কর্মস্থলে উপস্থিত হননি। এরপর থেকে সিইসিসহ অন্যরা অনিয়মিতভাবে যে যার সুবিধামতো সময় অফিস করে চলেছেন। তবে, মাঝে ১২ আগস্ট তারা জরুরি বৈঠকে বসেন। জানা গেছে, ওই বৈঠকে তারা পদত্যাগের বিষয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকে পদত্যাগের বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করারও সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব-পরিচয়ের সূত্র ধরে সিইসি নিজেই ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। তবে, বিভিন্ন মারফতে চেষ্টা হলেও সাক্ষাতের জন্য প্রধান উপদেষ্টার দফতরের কোনও সাড়া মেলেনি বলে নির্বাচন কমিশন ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য, সরকার পতনের পরদিনই নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ চেয়ে নির্বাচন ভবনের প্রধান ফটকে ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, কমিশনারদের মধ্যে বর্তমানে আহসান হাবীব মোটামুটি নিয়মিত অফিস করছেন। অন্যরা মাঝে মধ্যে দফতরে আসেন। কমিশনার আনিসুর রহমান খুবই কম আসেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরপরই প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতি এবং অ্যাটর্নি জেনারেল পদত্যাগ করেছেন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এখনও পদত্যাগ করেননি। অপরদিকে বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর মধ্যে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা পদত্যাগ করেছেন। তবে, গুরুত্বপূর্ণ বিধিবদ্ধ সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের কেউই এখনও পদত্যাগ করেননি। জানা গেছে, ইসির মতো দুদকের চেয়ারম্যানসহ কমিশনাররাও পদত্যাগের প্রস্তুতি নিয়েছিল। তবে, সরকারের গ্রিন সিগন্যাল না পেয়ে পদত্যাগের ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরে চলো নীতিতে রয়েছে।

এদিকে, সাক্ষাতের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার দফতরের সাড়া না পেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল একটি জাতীয় দৈনিকে মতামত কলাম লিখেছেন। ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংকটে। আলোচনার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কমিশনের প্রধান হিসেবে পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করাই সমীচীন মনে করছি।

নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও সফল বিপ্লবোত্তর সাংবিধানিক পরিস্থিতিতে সংকটে রয়েছে উল্লেখ করে সিইসি লিখেছেন, নির্বাচন কমিশন হয়তো অচিরেই বিগত হবে। কিন্তু এতে সংকটের নিরসন হবে না। সংসদ অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে ভেঙে দিতে হয়েছে। সংবিধান যদি বহাল থাকে তাহলে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের বিধানমতে তৎপরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। যদি না করেন, তাহলে সে ক্ষেত্রে ৭খ অনুচ্ছেদের বিধানমতে কমিশনাররা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ করে থাকবেন।

এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহম্মদ ইউনূস রবিবার (২৫ আগস্ট) প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি নির্বাচন কমিশনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের কথা বলেছেন। তিনি বলেন,  আমরা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করবো। কমিশনকে যে কোনও সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখবো।

ড. ইউনূস বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে।

নির্বাচন কমিশনারদের ঘনিষ্ঠ ইসির কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কমিশনারদের সকলেই পদত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। তারা দফতরে থাকা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও ডকুমেন্ট ইতোমধ্যে বাসায় নিয়ে গেছেন।

জানা গেছে, কমিশনারদের মধ্যে আনিসুর রহমান স্বেচ্ছায় পদত্যাগে প্রস্তুত হলেও অন্যরা সরকারের বার্তার অপেক্ষা করছে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা পেলে সেই অনুযায়ী তারা সরে দাঁড়াবেন। অবশ্য সরকারের সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন তাদের সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত হলেও ঠিক এই মুহূর্তে তাদের অগ্রাধিকারে নেই। এই মুহূর্তে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রশাসনসহ অত্যাবশ্যকীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ আনতে চায়। এরপর ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হাত দেবে। আইন অনুযায়ী নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগে বিচার বিভাগ, পিএসসি ও সিএজি’র একটি ভূমিকা থাকায় আগে এসব প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর জোর দেবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমি আমার বা কমিশনের অবস্থান নিয়ে একটি লেখা লিখেছি। সেখানে আমি অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আপাদের যেটা বুঝার সেখান থেকে বুঝে নিন।

আপনাদের পদত্যাগের কোনও প্রস্তুতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের পদত্যাগের কোনও প্রস্তুতি নেই। যখন প্রয়োজন হবে তখন জানতে পারবেন।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি কারও আস্থা নেই। কাজেই বর্তমান সরকারের সংস্কারের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটি অগ্রাধিকারে থাকবে বলে আমি মনে করি। সরকার এখনও কোন সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আগে কোনটা পরে কোনটা সংস্কার হবে এটা বলার সময় এখনও আসেনি। সরকার সংস্কারের কাজে হাত দিলে এটা বলা যাবে।

বর্তমান কমিশনকে চলেই যেতে হবে এমনটা জানিয়ে বদিউল আলম বলেন, তারা এই মুহূর্তে পদত্যাগ করবে না সময় নেবে এটা তাদের ব্যাপার। তবে, আমি মনে করি সরকারের সঙ্গে তাদের কথা বলা দরকার।