‘ফর্সা’ হওয়ার নেপথ্যে আছে চাষও, কীভাবে? মাংস-মাছের কথাও তুলে ধরলেন বিশেষজ্ঞরা

আজকের আধুনিক যুগেও বর্ণবাদ ও জাতিবাদ বহাল তবিয়তে রয়েছে৷ দক্ষিণ এশিয়ায় আজ কালো মেয়ের বিয়ে কীভাবে হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা যায়৷ পশ্চিমী বিশ্বে তার স্বরূপ তো আছেই৷ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে গোটা বিষয়টিই কিন্তু হাস্যকর৷

জার্মানির মাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এভোলিউশনরি অ্যানথ্রোপলজির শীর্ষ কর্মকর্তা ইয়োহানেস ক্লাউসে বলেন, ‘আমরা যে সাদা ও কালোর মধ্যে তফাত করি, তা সত্যি অদ্ভুত৷ কারণ আমাদের ত্বকের রংয়ে নানা বৈচিত্র্য রয়েছে৷ কিন্তু সাদা ও কালো একেবারেই নেই৷’

তাহলে জাতি ও বর্ণ নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে ইয়োহানেস ক্লাউসে বলেন, ‘প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৪৫,০০০ বছর আগে মানুষ আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে ইউরোপে এসেছিলেন৷ তাঁরা আফ্রিকার উত্তরে সাহারা অঞ্চল থেকে এসেছিলেন৷ ফলে তাঁদের ফিনোটাইপ আজকের সাব-সাহারান আফ্রিকার মানুষের মতোই কালোর দিকেই ছিল৷ প্রায় ৫,০০০ বছর আগে তাঁদের ত্বকের রং আরও হালকা ছিল৷ ত্বকের রং সম্প্রতি বদলে গিয়েছে৷ আমাদের মতে, মানুষের হালকা ত্বকের রং পাওয়ার পিছনে কৃষিকাজ শুরু করার একটা ভূমিকা রয়েছে৷’’

বিজ্ঞানের সেই শাখা সম্পর্কে ক্লাউসে বলেন, ‘আর্কিওজেনেটিক্স আসলে প্রত্নতত্ত্ব ও জেনেটিক্সের সংমিশ্রণ৷ আমরা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত অতীতের জেনেটিক উপাদান বিশ্লেষণ করি৷ অতীতে মানুষের মধ্যে জেনেটিক সম্পর্ক কেমন ছিল, তা বলতে পারি৷’

তবে প্রথমে গবেষকরা মানুষের অস্তিত্বের আগের সময়কার উপাদান বিশ্লেষণ করেছেন৷ ক্লাউসে জানান, ‘আমাদের বিশ্লেষণ করা সবচেয়ে প্রাচীন জিনোম প্রায় ১৫ লাখ বছর পুরনো৷ সেটা পার্মাফ্রস্টের মধ্যে অক্ষত এক ম্যামথের দেহের অংশ৷ উত্তরে বিশাল রেফ্রিজারেটরের মতো উপাদান খুব ভালো করে সংরক্ষিত রয়েছে৷ সেখান থেকে শুরু করে আমরা মধ্য ইউরোপেও নজর দিই৷ আমরা কিন্তু জুরাসিক যুগে ফিরে যেতে পারি না৷ কিছু মানুষ চাইলেও আমরা ডাইনোসরের ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে পারি না৷ কিন্তু আমরা এক লাখ, এমনকী দশ লাখ বছর পর্যন্ত ফিরে যেতে পারি৷’

কিন্তু সে সবের সঙ্গে জাতি এবং ত্বকের রংয়ের সম্পর্ক কী?

ল্যাবে ইয়োহানেস ক্রাউসে প্রথম যুগের মানুষের হাড় বিশ্লেষণ করেছেন৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ত্বকের রংয়ের কীভাবে বিবর্তন ঘটেছে, সেই ডিএনএ তার হদিশ দিয়েছে৷ ইয়োহানেস ক্লাউসে মনে করিয়ে দেন, ‘মানুষ খাদ্য উৎপাদনকারী হয়ে উঠেছিলেন৷ তাঁরা মূলত গম বা যব থেকে শস্য উৎপাদন করতে শুরু করেছিলেন। তখন তাঁরা প্রায় পুরোপুরি নিরামিষাশী হয়ে উঠেছিলেন৷ অর্থাৎ চার বা পাঁচ হাজার বছর আগের প্রথম চাষিরা বেশি মাংস বা মাছ খেতেন না৷’

তিনি আরও বলেন, ‘সেটা কিন্তু ইউরোপে বাস করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে উঠেছিল, কারণ ইউরোপ খুব অন্ধকার জায়গা৷ আপনি নিরামিষাশী ও কৃষ্ণাঙ্গ হলে শীতকালে শরীরে ভিটামিন ডি-র অভাব দেখা দেবে৷ কারণ আমরা জানি, সূর্যের আলো ত্বকের মধ্যে ভিটামিন ডি উৎপাদন করতে পারে৷ কিন্তু আপনার ত্বকের রং কালো হলে আপনি কোনও শ্বেতাঙ্গের তুলনায় কম ভিটামিন ডি উৎপাদন করবেন৷’

সঙ্গে তিনি বলেন, ‘একই সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ত্বকের রং উজ্জ্বল হতে শুরু করল৷ কিন্তু সেই সব মানুষের মধ্যে মোটেই নিবিড় সম্পর্ক ছিল না৷ যেমন এশিয়ার পূর্বে এবং ইউরোপের মানুষ৷ সেটা অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে৷ তাই ত্বকের রংয়ের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করার কোনও অর্থই হয় না৷’

মোটকথা সামান্য কিছু মিউটেশনের কারণে মানুষের ত্বকের রংয়ে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে৷ সেটাই কি তাহলে বর্ণবাদের কারণ? বিজ্ঞানীরা বহুকাল ধরে জানেন যে. সব আধুনিক মানুষের ডিএনএ ৯৯ দশমিক নয় শতাংশ সমান৷ বাকিদের মধ্যে অতি সামান্য তফাত রয়েছে৷ অর্থাৎ আমরা যাকে ‘রেস’ বা ‘জাতি’ বলি, তার কোনও জিনগত ভিত্তিই নেই৷ সেই শব্দটি প্রায়ই ক্ষমতা ও নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ 

ইয়োহানেস ক্লাউসে বলেন, ‘আমি অবশ্যই মনে করি বিশ্বের সব জায়গায় বর্ণবাদের অস্তিত্ব রয়েছে৷ সেটা মোটেই শুধু ইউরোপের সমস্যা নয়৷ সব মহাদেশেই সেটা রয়েছে৷ সেটা মূলত সম্পত্তি ও ক্ষমতাই প্রাধান্য পায়৷ সেই ডায়নামিক্স বা রসায়ন সব জায়গায় রয়েছে৷ কিছু অসাধারণ এক্সপেরিমেন্ট রয়েছে৷ যেমন এক স্কুলের ক্লাসের অর্ধেককে নীল শার্ট ও বাকিদের লাল শার্ট দেওয়া হল৷ তখন দুই গোষ্ঠীর মধ্যে অদ্ভুত রসায়ন দেখা যায়৷ ফুটবল ফ্যানদের মধ্যেও সেটা ঘটে৷ অথবা প্রতিবেশী গ্রামের সঙ্গে রেষারেষি৷’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে মানুষ ভিন্নদের দেখে বিচ্ছিন্ন করে দেয়৷ মানুষ সহজেই বহিরাগত বা ভিন্ন গোষ্ঠীকে চিহিত করেন৷ আমার মতে, সংস্কৃতি সেই বাধা অতিক্রম করে৷ আমরা পশু নই, আমাদের কোনও প্রবৃত্তি অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই৷ আমাদের ফাইলোজেনেটিক ট্রি আফ্রিকা-ভিত্তিক৷ গাছ, তার কাণ্ড, সবচেয়ে মোটা শাখা-প্রশাখা সবই আফ্রিকায় রয়েছে৷ আফ্রিকার বাইরে ক্ষুদ্র জেনেটিক ডাইভার্সিটি পাওয়া যায়৷ কিন্তু সব প্রধান বংশ পরিচয় আফ্রিকার মধ্যেই রয়েছে৷’

(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)