আমরা কি ‘খিলাফা-ই-বাংগাল’-এর জন্য প্রস্তুত?

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দুটি অশুভ লক্ষণ দৃশ্যমান হয়:

১. ২০১৩ সালে নাস্তিক ব্লগারদের হত্যার জন্য দায়ী জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধানের কারাগার থেকে মুক্তি এবং ০২. সন্ত্রাস ও সহিংসতার জন্য বহু আগেই নিষিদ্ধ ঘোষিত বহুজাতিক জিহাদি সংগঠন হিযবুত তাহরীর, যারা ০৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-চেষ্টার জন্যও স্বেচ্ছায় দায় স্বীকার করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তাদের পুনঃপ্রবেশ।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, হিযবুত তাহরীর ০৯ আগস্ট বাংলাদেশকে একটি ‘খিলাফা’ রাষ্ট্র বা খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে। উপসংহারে এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ক্ষমতা গ্রহণের তৃতীয় সপ্তাহেও বাংলাদেশের এই ‘না সাংবিধানিক না বৈধ’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানাবিধ বিশৃঙ্খলা নিরসনে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং অদক্ষতার সঙ্গে জাতিকে ঘিরে থাকা অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার যেন কোনও শেষ নেই।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক শূন্যতার এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা আর ঘটেনি, এমনকি ১৯৭১ সালের পরও নয়।

মৌলবাদীদের তোষণ:

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই রক্ষণশীল চরম ডানপন্থি মৌলবাদী দলগুলোর প্রতি ড. ইউনূসের ব্যাখ্যাতীত প্রীতির সঙ্গে এবার উপরের বিষয়গুলো যোগ করুন। এর ফলস্বরূপ দেখতে পাবেন, ০৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করার কৃতিত্ব জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের ‘বিপ্লবী’ এবং ‘জনগণের ত্রাণকর্তা’ বর্ণনা করে তাদের সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় পাতার পর পাতা লিখা হচ্ছে।

এসব মনগড়া বিশ্লেষণে বিশ্বাস রাখার মতো বিশাল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ফেসবুকে বিরাজমান বৈকি! সত্যিটা হলো দেশের ১৮০ মিলিয়ন জনগণের মধ্যে মোটামুটি এক মিলিয়ন যদি এই ‘আষাঢ়ে বিপ্লবে’ যোগ দিয়ে থাকে, তাহলে বাকি ১৭৯ মিলিয়নই কিন্তু তাতে যোগ দেয়নি– যার মানে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ‘ফ্যাসিস্ট’ নয় এবং তারা কাপুরুষ বা বোকাও নয়।

তাই জামায়াত-শিবিরের প্রতি সমর্থনের প্রসঙ্গে ‘জনগণ’ নামক শব্দগুচ্ছটি যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা সর্বৈব মিথ্যা এবং বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন, যার বৃহত্তর লক্ষ্যই হলো ভিড়ের মধ্যে থেকে বীরত্ব দেখানো এবং আমজনতাকে বিভ্রান্ত করা।

নেট দুনিয়ায় শোরগোল:

আমাদের গবেষণা এবং বিভিন্ন প্রতিবেদন ও প্রচারণামূলক ভিডিওর বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে– অনলাইনে চটকদার ও অতিরঞ্জিত লেখালেখিতে সিদ্ধহস্ত এবং ডানপন্থিদের এজেন্ট অনেক উসকানিদাতা ড. ইউনূসের কাছে দাবি করছে:

ক) তিনি যেন রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং খ) বর্তমান সংবিধানকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে ‘বিপ্লবোত্তর’ আদর্শের সঙ্গে মানানসই নতুন সংবিধান রচনা করেন।

অনলাইনে মগজধোলাই করা এসব ভিডিও মূলত গুপ্ত সংগঠন হিজবুত তাহরীরের এজেন্ডাকেই জায়েজ করতে এবং নির্বোধদের ঘটিবুঝ দিয়ে ভুলিয়ে রাখতেই ছড়ানো হচ্ছে।

ভোট ব্যাংক এবং নির্বাচনি কূটকৌশল:

জামায়াতে ইসলামী ইদানীং ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাজ ও রাজনীতির কথা খুব বলে যাচ্ছে, যদিও এই ‘অন্তর্ভুক্তি’র মধ্যে কেবল তাদের নিজেদের ভোট ব্যাংকই আছে, যার মধ্যে ‘সমমনা’ ইসলামি দলসমূহ, ‘কওমি মাদ্রাসা’র হুজুরেরা এবং ধর্মান্ধ মোল্লাগণ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এদের রাজনীতির ইশতেহারে নারী, তৃতীয় লিঙ্গ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি, ধর্মীয় এবং আদিবাসী সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামপন্থিদের, যেমন- সুফি বা এমনকি বামপন্থি দলগুলোকে ‘অন্তর্ভুক্ত’ করার মতো কোনও বিধান নেই।

২০২৪-এর ‘অবিসংবাদিত বীর’ কি তবে হিযবুত তাহরীর?

হিযবুত তাহরীরের গোপন কর্মপদ্ধতির কারণেই আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশে এমন সব ঘটনা তাদের পক্ষেই ঘটানো সম্ভব। কয়েক দশক ধরে তারা আমাদের সমাজের বুদ্ধিমান, শিক্ষিত এবং অভিজাত শ্রেণির শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সদস্যদেরও খিলাফতের ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে।

তাই শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনের অবসান ঘটাতে আন্দোলন বেগবান করতে যেভাবে দেশব্যাপী কেপিআইভুক্ত স্থাপনাসমূহ, পুলিশ স্টেশন ইত্যাদিকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা এবং এসব স্থাপনায় ক্ষিপ্রতার সঙ্গে, নিখুঁতভাবে চোরাগোপ্তা হামলা হয়েছে ও দক্ষতার সঙ্গে হুজুগে জনগণকেও তাদের পক্ষে ব্যবহার করা হয়েছে; তা থেকে সন্দেহাতীতভাবে বোঝা যায় যে এটা হিজবুত তাহরীরের মতো দক্ষ, পরিশীলিত, সুসংগঠিত এবং দারুণ মেধাবী শহুরে গেরিলাদের দ্বারাই কেবল সম্ভব ছিল।

এই যুদ্ধে ইসলামী ছাত্রশিবির এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা বড়জোর পদাতিক সৈনিক ছিল, নেপথ্যে সত্যিকার জেনারেল এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ছিল আসলে হিজবুত তাহরীর।

এই ছিল সংক্ষেপে ‘আষাঢ়ে বিপ্লবের’ সারাংশ। কিছু পূর্বাভাস– এরপর যা-কিছু ঘটতে পারে:

ঘটনা ১: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনাপত্তি এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং সংবিধান ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্থগিত করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন।

ঘটনা ২: অরাজকতা ও সহিংসতা অনিবার্যভাবে বাড়তে থাকবে, যার পরিণতিতে সামরিক আইন ঘোষণা করা হবে। ইসলামি শক্তিগুলোকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত আরও বেশি সংগঠিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হবে।

ঘটনা ৩: শরিয়া আইন অনুসারে দেশ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের নতুন সংবিধান রচনা করা হবে এবং বিশ্বের বুকে একটি নতুন খিলাফত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আবির্ভূত হবে। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য কঠোর পোশাক এবং নাগরিক আচরণবিধি ঘোষণা করা হবে, যা অমান্য করলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হবে।

ঘটনা ৪: ডক্টর ইউনূসকে আমির বা খলিফা ঘোষণা করা হবে, যা তাঁর আন্তর্জাতিক অবস্থানের কারণে মার্কিনি ও ইউরোপীয়দের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। গণতন্ত্রকে পুরোপুরি উৎখাত করে কিছু থিওক্রেট ও টেকনোক্রেট এবং পূর্ববর্তী কিছু রাজনৈতিক দলের অবশিষ্টাংশ নিয়ে একটি ‘নির্বাচিত’ শুরা মজলিশ গঠন করা হবে; ইং-মার্কিন জোট তাতে আপত্তি করবে না।

ঘটনা ৫: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ‘খিলাফা-ই-বাংগাল ’ বা ‘খেলাফায়ে বাংলা’ করা হবে, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হবে, নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি ইসলামপন্থি রঙের পতাকা এবং ইসলামি মূল্যবোধের জাতীয় সংগীত বেছে নেওয়া হবে। তবে জাতীয় পশু হিসেবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার মনে হয় টিকে যাবে!

লেখক: সংগীতশিল্পী