পাকিস্তানের মাটিতে বাঘের গর্জন

৫ উইকেট নিয়ে টেস্টের দ্বিতীয় দিন রাওয়ালপিন্ডির অনার্স বোর্ডে নাম লিখিয়েছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তৃতীয় দিনে একই বোর্ডে নাম তোলেন লিটন দাস। গতকাল চতুর্থ দিনে পেসার হাসান মাহমুদ ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেট নিয়ে একইভাবে নাম তুলেছেন অনার্স বোর্ডে। গত তিন দিনে বাংলাদেশের তিন ক্রিকেটারের এই পারফরম্যান্সেই বোঝা যাচ্ছে, সফরকারী হয়েও দ্বিতীয় টেস্টে স্বাগতিকদের মাঠে কতটা রাজত্ব ছিল বাংলাদেশের। পাকিস্তানকে পাড়ার দল বানিয়ে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ নিজেদের করে নিয়েছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। মঙ্গলবার দ্বিতীয় সেশনে সাকিব আল হাসানের বাউন্ডারিতে পাকিস্তানকে ৬ উইকেটে হারিয়ে ঐতিহাসিক এক সিরিজ ২-০ তে জিতেছে বাংলাদেশ।

২৪ বছরের টেস্ট ইতিহাসে বাংলাদেশ এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুবার ও জিম্বাবুয়েকে একবার হোয়াইটওয়াশ করেছে। তবে এমন অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশকে আগে কখনও দেখা যায়নি। ২০০৯ সালে অনেকটা খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তারা হোয়াইটওয়াশ করেছিল। বিদেশের মাটিতে তো বটেই, প্রতিপক্ষকে সেবারই প্রথম কোন টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করার স্বাদ নেয় তারা। এই সিরিজের পর ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ে এবং ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আবার হোয়াইটওয়াশ করে। তবে এই তিনটি টেস্ট সিরিজকে ছাড়িয়ে গেছে আজকের অর্জনকে।

পাকিস্তানের মাটিতে গত দুই টেস্টেই ছিল বাঘের গর্জন। অথচ টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার বাসিত আলী বলেছিলেন, ‘শুধু বৃষ্টিই পারে বাংলাদেশকে বাঁচাতে। এছাড়া কোনও সুযোগই নেই। পাকিস্তান ঘরের মাঠে অনেক সুবিধা পাবে।’ বাসির আলী এই বক্তব্য শেষ পর্যন্ত তাদের জন্যই বুমেরাং হয়ে এলো। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, বৃষ্টিই কেবল পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ থেকে বাঁচাতে পারতো। যদিও বৃষ্টি বিপদে ফেলেনি, দারুণ ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক এক টেস্ট সিরিজ নিশ্চিত করেছে।

প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটে জয়ের পর রাওয়ালপিন্ডিতে দ্বিতীয় টেস্ট জিততে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১৮৫ রান। সোমবার বাংলাদেশের দুই ওপেনার সাদমান ইসলাম ও জাকির হাসান ওয়ানডে স্টাইলে ব্যাটিং করে নিজেদের এগিয়ে রাখেন। লক্ষ্যটা ছিল চতুর্থ দিনের মধ্যেই খেলা শেষ করা। কিন্তু বৃষ্টিতে শেষ সেশনের বেশিরভাগ সময়ই বৃষ্টির পেটে চলে গেছে। শঙ্কা ছিল পঞ্চম দিনের ম্যাচ নিয়েও। শেষ পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডির আকাশে মেঘ কেটে যায় শেষ দিন। প্রথম সেশনে দুই উইকেট হারানোর পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় সেশনের শুরুতে হারায় নাজমুল হোসেন শান্তর উইকেট। মুমিনুল লম্বা শট খেলতে গিয়ে আউট হলে বাকি পথটা সহজেই পেরিয়ে যান সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম।

বৃষ্টিতে প্রথম দিন ভেসে গেলে দ্বিতীয় টেস্টটি রূপ নেয় চারদিনে। টস জিতে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ পাওয়া পাকিস্তানকে ২৭৪ রানে অলআউট করে বাংলাদেশ। সফরকারী দলের পেসার তাসকিনের গতিময় বোলিংয়ের পর অফস্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজের ঘূর্ণিতে কুপোকাত হয় স্বাগতিক ব্যাটিং লাইনআপ। সাইম আইয়্যুব (৫৮) ও শান মাহমুদ (৫৭) ছাড়া আর কেউই সেভাবে প্রতিরোধ করতে পারেনি। বাংলাদেশের স্পিনার মিরাজ ৫ উইকেট নিয়ে প্রথমবারের মতো পিন্ডির অনার্সবোর্ডে নিজের নাম তোলেন। তাসকিন নেন তিনটি উইকেট।

পাকিস্তানকে অল্প ব্যবধানে অলআউট করে বাংলাদেশের দারুণ শুরু আশা করছিলেন সমর্থকরা। কিন্তু পাকিস্তানের দুই পেসার মির হামজা ও খুররাম শাহজাদের বোলিং তোপে ২৬ রানে বাংলাদেশ হারায় টপ অর্ডারের ৬ উইকেট। প্রথম ৬ ব্যাটারের মধ্যে কেবল সাদমান ইসলাম দুই অঙ্কের (১০) ঘরে রান করতে পেরেছেন। সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক ও নাজমুল হোসেন শান্তরা পাকিস্তানের সুইং বোলিংয়ের বিপক্ষে খেই হারিয়েছেন। ঠিক সেই ধ্বসংস্তূপে থেকে সপ্তম উইকেট মেহেদী হাসান মিরাজ ও লিটন দাস মিলে দারুণ প্রতিরোধ গড়েন। ১৪৭ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৫০ রানের কমে ৬ উইকেট হারানোর পর দেড়শ রানের জুটি ছিল না আগে। এমন অসাধ্য কাজটিই করে দেখিয়েছেন তারা দুইজন। খুররাম শেহজাদকে মিরাজ রিটার্ন ক্যাচ দিতেই ১৬৫ রানের জুটি ভাঙে তাদের। ১২৪ বলে ১২ চার ও ১ ছক্কায় ৭৮ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেন মিরাজ। অফস্পিনিং এই অলরাউন্ডার সেঞ্চুরি মিস করলেও লিটন ঠিকই তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করেন। লিটনের এই সেঞ্চুরিতেই বাংলাদেশ দল ২৬২ রানের সংগ্রহ দাঁড় করাতে পারে। ২২৮ বলে ১৩ চার ও ৪ ছক্কায় ১৩৮ রানের ইনিংস খেলে লিটনও পিন্ডির অনার্স বোর্ডে নাম তুললেন!

১২ রানে এগিয়ে থেকে পাকিস্তান তাদের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করলেও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি স্বাগতিকদের ইনিংস। বাংলাদেশের তিন পেসারের বোলিং তোপে অলআউট হয় ১৭২ রানে। সফরকারীরা পায় ১৮৫ রানের লক্ষ্য।

তিন পেসার হাসান মাহমুদ পাঁচটি, নাহিদ রানা চারটি এবং তাসকিন আহমেদ একটি উইকেট নেন। ক্যারিয়ারে প্রথমবার ৫ উইকেট নিয়ে হাসান রাওয়ালপিন্ডির অনার্সবোর্ডে মিরাজ ও লিটনের মতো নিজের নাম লেখান। শুধু কি তাই? টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ারও কীর্তি গড়েছেন বাংলাদেশের পেসাররা।