শিক্ষার্থীদের সাথে ‘গুন্ডামি’ করতেন শিক্ষক সঞ্জয় মুখার্জী

একজন শিক্ষকের মধ্যে নিহিত থাকে ভালোবাসা, স্নেহ ও শাসন। সন্তান এবং পিতার সম্পর্ক যেমন বন্ধুসুলভ হয় ঠিক তেমনি ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কও হয়ে থাকে বন্ধুসুলভ। তবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এক আতঙ্কের শিক্ষক সঞ্জয় কুমার মুখার্জী।

পড়া বুঝিয়ে চাওয়ায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দিয়ে হুমকি ও হল থেকে নামিয়ে দেওয়া, নাম্বার টেম্পারিং, শিক্ষার্থীকে রুমে আটকিয়ে মানসিক নির্যাতন,সাংবাদিকদের আইনের ভয় দেখানো,উপাচার্যের অনুগত ব্যক্তিকে ছাত্রলীগের কমিটিতে আনতে রেজাল্ট আটকে রাখা,উপাচার্যের বিরুদ্ধে কথা বলায় হুমকি,বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাধা দেওয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে সঞ্জয় কুমার মুখার্জীর বিরুদ্ধে।

পাঠদানের নামে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের অত্যাচার, মানসিক নির্যাতন এবং নানা রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছেন তিনি। নিজেকে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের অনুসারী পরিচয়ে এসব অপকর্ম করে আসছিলেন তিনি। এতদিন ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস না পেলেও সরকার পতন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের পদত্যাগের পর সামনে আসতে শুরু করেছে তার এসব কুকীর্তি। 

সম্প্রতি সঞ্জয় মুখার্জীর দ্বারা সংঘটিত অত্যাচার,নির্যাতন এবং অনিয়মের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তার তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তারই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. নুরে  আলম। সরকার পতনে পর নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা সহকারী অধ্যাপক নুরে আলমের কাছে সেসব ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সাথে ঘটে যাওয়া সেসব কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট করেছেন তিনি।  

সঞ্জয় কুমার মুখার্জীর অত্যাচার-নির্যাতনের এক ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘উনি একদিন ক্লাস নিচ্ছিলেন, এক ছাত্র দাঁড়িয়ে বলেন,স্যার এই টপিকটা ডিটেইলস বুঝিয়ে বলেন। উনি রেগে যান। ক্লাস শেষে ঐ ছাত্র ছাত্রলীগ নেতার নিকট হতে কল পান এবং ঐ ছাত্রকে হল থেকে বের হয়ে যেতে হবে বলে জানান ছাত্রলীগের নেতারা।’ 

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হাসান মাহমুদের(ছদ্মনাম) বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘এক ছাত্র প্রথম বর্ষে ছাত্রলীগের এক নেতাকে  মেইনটেইন করতো। ঐ নেতার সাথে তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের(বাবু-রাকিব) দ্বন্দ্ব হয় এবং একটা সময় শিক্ষক সঞ্জয় মুখার্জীর সাথেও ঐ ছাত্রলীগ নেতার মনোমালিন্য হয়৷ এর ফলাফল হিসেবে উনি সেই শিক্ষার্থীর ৪ টি কোর্সে নাম্বার কমিয়ে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।  এই রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে নাকি সঞ্জয় কুমার মুখার্জীর নাম্বার টেম্পারিং এর স্বীকার হতে হয়েছে।’

নুরে আলম বলেন , ‘বিভাগের ১১তম ব্যাচের রেজাল্ট এক বছরের অধিক সময় উনি আটকিয়ে রেখেছিলেন শুধু উপাচার্যের অনুগত ক্যান্ডিডেটকে ছাত্রলীগের কমিটিতে আনার জন্য। বিভাগের ১২ তম ব্যাচের রেজাল্ট হলে ১১ তম ব্যাচের সবাই মিলে শ্রেণি-প্রতিনিধিকে উনার কাছে পাঠান। অন্যরা ভয়ে তার কাছে যেতে পারেনি, কারণ উনি সর্বদা হুমকির উপর রাখতেন। ঐ শ্রেণি-প্রতিনিধিকে উনি কয়েকঘণ্টা আটকিয়ে রেখে ভয়াবহ, অমানুষিক, বীভৎস নির্যাতন করেন। ২ বছর আগে মাস্টার্স কমপ্লিট করা ২৫/২৬ বছরের একটা তরতাজা যুবক ঐ নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আমার কাছ হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। 

এসব বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক নুরে আলম বলেন ‘ উনার জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়নের যেই অভিযোগ আমার কাছ, তা বর্ণনা করতে হলে একটা বই লিখতে হবে।বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার আগে বিভাগ থেকে শুরু করতে হবে। ভয়ের সংস্কৃতি, হুমকির প্রবণতা, নাম্বার টেম্পারিং এর মতো অপকর্ম, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন, ক্লাসরুমে গণহারে শিক্ষার্থীদের অপমান, অপদস্থ বন্ধ করতে হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, সঞ্জয় কুমার মুখার্জী ২০১৩ সালের ১০ মার্চ লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই তিনি নিজেকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এই পরিচয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব খাটাতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের সময়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের আস্থাভাজন হয়ে বাগিয়ে নেন প্রক্টরের পদ। পরবর্তীতে তাকে দেওয়া হয় বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব।

এদিকে এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। প্রশ্ন উঠেছে তার শিক্ষকতার যোগ্যতা নিয়ে।সমালোচনার মুখে সঞ্জয় কুমার মুখার্জী ফেসবুক পোস্টে ক্ষমা চেয়ে গত ২৮ আগস্ট(বুধবার) বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করলেও শিক্ষকতা পেশা থেকে তার পদত্যাগ ও শাস্তির দাবি করেছেন ভুক্তভোগী অনেকে। 

লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাসিয়াত আরা মারিয়া(ছদ্মনাম) বলেন ‘ উনি শিক্ষকতার নামে বিভাগে গুন্ডামি করতেন।ছাত্রলীগের পরিচয় ব্যবহার করে বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোণঠাসা করে রাখতেন। শিক্ষার্থীরা উনার মতের বিরুদ্ধে গেলেই শিক্ষার্থীদের কঠিনভাবে শ্বাসাতেন,বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি ও মানসিক নির্যাতন করতেন। উনি শিক্ষকতা পেষাটাকেই কলুষিত করেছেন।এ ধরনের শিক্ষককে আমরা এই বিভাগে চাইনা।উনি যেহেতু ক্ষমা চেয়েছেন সেহেতু উনি অপরাধ গুলো স্বীকার করেছেন। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। ’ 

বিভাগটির সাবেক শিক্ষার্থী ফরিদ আহমেদ ফাহাদ বলেন ‘উনি আসলে শিক্ষক নয়, সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার। উনি একজন গুন্ডা,সন্ত্রাসী। উনি টিচার হওয়ার কোনোভাবেই যোগ্য না। নিয়োগ নিয়েছেন অবৈধভাবে। উনার না আছে পড়ানোর যোগ্যতা না আছে ম্যানারের দিক দিয়ে যোগ্যতা। উনি ক্লাসে আসবেন ত্রিশ মিনিটের জন্য এর মাঝে বিশ মিনিট নানান বয়ান পেশ করবেন আর বাকি দশ মিনিট মোবাইল দেখে দেখে অনুবাদ পাঠ করবেন। আর উনার ক্লাস শিডিউল যদি থাকে ১০টায় উনি আসবেন ১২ টায়। আর কোনো ছাত্রের প্রতি যদি আক্রোশ থাকে তাহলে ক্লাসের মধ্যে তাকে নানান ভাবে থ্রেট দিয়ে তার ক্ষমতার দাপট দেখাবেন। অনেক শিক্ষার্থীদের সাথে নাম্বার টেম্পারিং করেছেন। নিজের পছন্দের ছাত্রকে টিচার বানাতে ফার্স্ট বানিয়েছেন। উনার মতো অযোগ্য, গুন্ডা একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার হতে পারে না।’

লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিফাতুল হক বলেন ‘কিন্ডারগার্টেনের যোগ্য না, উনাকে নিয়ে আসা হয়েছে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করানোর জন্য। তার ব্যক্তিগত আক্রোশে অঙ্কুরেই নষ্ট হয়েছে কতশত শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন।উনি ডিপার্টমেন্টে থাকলে আরো কত শত শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট করবে তার শেষ নেই।তাই প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসাবে অবিলম্বে উনার পদত্যাগ দাবি করছি।’

শুধু বিভাগেই নয় প্রক্টর হিসেবেও সঞ্জয় মুখার্জীর  বিরুদ্ধে প্রক্টর অফিসে ডেকে নিয়ে হুমকি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাধা দেওয়া, ছাত্র আন্দোলনের সময়ে ক্যাম্পাসে গ্রাফিতি আঁকতে আনসার সদস্যদের দিয়ে বাধা প্রদান,সাংবাদিকদের আইনের ভয় দেখানো সহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনার কারণে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে গত ৭ আগস্ট তাকে প্রক্টরের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। 

আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থী মোরসালিন রহমান শিকর বলেন ‘ক্যাম্পাসের একমাত্র শিক্ষার্থী হিসাবে আমি সিঙ্গাড়া হাউজ নামে ছোট পরিসরে ক্যাম্পাসের ভেতরেই চা-সিঙাড়া-জুস-বার্গার ইত্যাদি বিক্রয় করতাম। উনি প্রক্টর হয়ে আসার পরেই বিভিন্নভাবে আমাকে দোকান চালানো যাবে না, সম্ভব না, ভিসি স্যারের অফিস থেকে তোমার দোকান উঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে, তোমার দোকান রাস্তার মাঝে ইত্যাদি ফর্মালিটি দেখিয়ে মানসিকভাবে চাপে রাখতো। শেষমেশ উনি নিজে দোকান উঠাতে না পেরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের লেলিয়ে দেন এবং একপর্যায়ে রাজনৈতিক চাপ দিয়ে দোকান বন্ধ করাতে বাধ্য করেন। পরে নেতাকর্মীদের চাঁদা দিতে বাধ্য হয় এবং দোকান খোলা অনুমতি পাই।’

এম এ হাদী নামের এক শিক্ষার্থী বলেন ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন একটা সিরাত পাঠ অনুষ্ঠান আয়োজন করায় তুমুল যুদ্ধ বাধিয়ে ছিলেন এই শিক্ষক। ময়মনসিংহ থেকে পুলিশকেও খবর দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে প্রোগ্রাম শেষে আয়োজকদের মারাত্মক রকমের মাস্তানি ভাষা ব্যবহার করে হুমকি দিয়েছিলো।’

ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান রবিন বলেন ‘উনার জনসম্মুখে ক্ষমা চাওয়া উচিত।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে তার ভূমিকা কেউ ভুলে যায়নি।উনি শিক্ষার্থীদের দেয়ালে গ্রাফিতি পর্যন্ত আঁকতে দেয়নি।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো: শফিকুল ইসলাম বলেন ‘ ঘটনাগুলো খুবই নিন্দনীয় এবং দুঃখজনক। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এই ধরনের আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ধরনের শিক্ষকরাই শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করেছে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের  শিক্ষক কোথাও নিয়োগ পেতে না পারে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন ‘ এ ধরনের ঘটনায় শিক্ষক হিসেবে আমরা খুবই লজ্জিত।বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী এই ধরনের শিক্ষকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’

অভিযোগের বিষয়ে সঞ্জয় কুমার মুখার্জীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘আমি অতীতেও শিক্ষার্থীদের সাথে ছিলাম এখনও শিক্ষার্থীদের সাথে আছি। আমার কোথায় কি সমস্যা আছে সেই অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্টভাবে জানলে আমার জন্য ভালো হয়।’



মুনতাসির/সাএ