বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর দেখে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় শেষ পুরো পরিবার

চোখ বন্ধ। কপালে, গালে, হাতে ও মাথা শরীর মোড়ানো তোয়ালেতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। যেন ঘুমাচ্ছে শিশুটি। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মহাসড়কে বাবা-মায়ের নিথর দেহের পাশের ব্যাগে শিশুটিকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। দৌড়ে এসে কোলে নিয়ে একজন নাড়াচ্ছিলেন সাড়া দেওয়ার জন্য। ততক্ষণে প্রাণ আর নেই শিশুটির শরীরে, কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রত্যক্ষদর্শীরা। কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা ও নানির সঙ্গে সেও হারিয়েছে প্রাণ।

তার নাম সাইমান (৫ মাস)। একই সঙ্গে নিহত হয়েছেন সাইমানের বাবা ফেনী সদরের মোটবী ইউনিয়নের দক্ষিণ লক্ষ্মীপুর গ্রামের মো. মামুন (৪০), তার নানি মাজেদা বেগম (৭০) ও মাইক্রোবাসচালক ফেনী সদরের মাস্টারপাড়ার হাসান হাজারির ছেলে আলাউদ্দিন হাজারি (২৭)। তারা সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী। একই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন সাইমানের মা লাকি বেগম ও তার বাকি তিন বোন।

শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) ভোর সাড়ে ৬টার দিকে কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামের বাতিসা নানকরা এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, অতিরিক্ত গতির কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর একটি পরিবার শেষ হয়ে গেছে।

নিহতের ফুফাতো ভাই ওমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামুন ভাইয়ের তিন মেয়ে ও এক ছেলে সাইমান। আজ যাওয়ার সময় ছেলেটাকে বুকে নিয়ে মাইক্রোর সামনে বসেছিলেন। এ সময়ও ছেলেটা হাসছিল। ভাই তার হাত ধরে সবাইকে টাটা দিয়েছিলেন। আজ সকালেও যেই বাড়িতে আমোদ-ফুর্তি ছিল আজ সেই বাড়ির অনেক দূর থেকেও কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। চারদিকে শুধু কান্না আর কান্না। আমার মামির আর্তনাদ কীভাবে আটকাবো জানি না। ওনার বোনেরাও কান্না করছেন। আমার পরিবারও ভেঙে পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সকাল হওয়াতে রাস্তা ফাঁকা ছিল। হয়তো গাড়ি জোরে চলছিল। একটা দুর্ঘটনা আমাদের পরিবারগুলোকে শেষ করে দিলো। ভাইয়ের একমাত্র ছেলে মারা গেছে। মেয়েরা ও তার মা হাসপাতালে। শুনেছি অবস্থা আশঙ্কাজনক।’

তাদের দাফনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মামুন ভাই ও তার ছেলেকে একসঙ্গে দাফন করা হবে। তার শাশুড়িকে ঢাকায় ও চালককে তার এলাকায় দাফন করা হবে। এখন পর্যন্ত এমনটাই শুনেছি।’

নিহত মামুনের ভাই মো. হানিফ বলেন, ‘মামুন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করতো। সেই সুবাদে পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই থাকতো। বাড়িতে থাকতাম মা আর আমি। সে আমার ছোট ভাই। এলাকায় বন্যায় সব তলিয়ে যায়। আমরা কোনোরকম নিরাপদ আশ্রয়ে যাই। এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভালো তাই আমার ভাই সপ্তাহখানেক আগে ঢাকা থেকে আমাদের দেখতে এসেছে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার করেছিল। সব ঠিকঠাক করেছে। সে আমাদের পরিবারকে দেখতো। এসেছিল সন্তান, স্ত্রী ও শাশুড়িকে নিয়ে। আজ সকালে নোহা মাইক্রোবাসে করে তারা ঢাকায় যাচ্ছিল। আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরছিল। কিছুক্ষণ পর মোবাইলে ভাইয়ের কল আসে। কল রিসিভ করতেই একজনে বলে ওঠেন, আমার ভাইসহ পরিবারের কয়েকজন মারা গেছেন। তখন আর হাত-পা চলছিল না। কোনোরকমে ঘটনাস্থলে আসি। এসে দেখি আমার ভাই ও ভাতিজার লাশ পড়ে আছে রাস্তার পাশে। সে আমাদের পরিবার দেখতো। ভাই ছাড়া আমরা কী করবো সামনে জানি না। তার মেয়েরা কী নিয়ে বাঁচবে কে জানে! একটা পরিবার শেষ।’

পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ভোরে দুর্ঘটনা ঘটেছে। তখন রাস্তা খালি ছিল। তাই গাড়ির গতিও অনেক বেশি ছিল। ঢাকাগামী লেনের পাশেই একটা পিকআপ নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল। সম্ভবত ওই মাইক্রোচালক তা আগে লক্ষ করেননি। খুব সামনে আসার পর ব্রেক করে ডানে টার্ন করেন। এ সময় গাড়ির গতিও কমে যায়। আর হঠাৎ ডানে টার্ন করাতে পেছনে থাকা স্টারলাইন পরিবহনের বাসটি মাইক্রোকে চাপা দেয়। যদি সোজা যেতো তাহলে পিকআপে লাগতো। যদি বেশি বামে যেত সড়ক থেকে ছিটকে যেতো। কিছুই করার ছিল না। মাইক্রোবাসটি দেখলেই বোঝা যায় কতটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।

মিয়াবাজার হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রইছ উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনাস্থলে চার জন নিহত হয়েছেন। আহত কয়েকজন হাসপাতালে রয়েছেন। আমরা দুর্ঘটনাকবলিত বাস এবং মাইক্রোবাস থানায় নিয়ে এসেছি। পরিবারের নিকট লাশ হস্তান্তর করা হচ্ছে এবং এই বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।’

আরও পড়ুন:

বাসের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ৪ যাত্রী নিহত