শিগগিরই বিদ্যুৎ সংকট উত্তরণের সম্ভাবনা কম

বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বল্প সময়ের মধ্যে জ্বালানির সংস্থান করা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। দেশীয় জ্বালানির সরবরাহ দিনের পর দিন কমছে। অপরদিকে আমদানি- নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় ডলারের সংস্থান করাও সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে দেশীয় জ্বালানির অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হলেও সেটি সময়সাপেক্ষ বিষয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, খুব শিগগিরই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা কম। এক্ষেত্রে আগামী বছর থেকে পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়ার ওপরে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় দেশে লোডশেডিং প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতি বছর এ সময়ে লোডশেডিং স্বাভাবিক বিষয় হলেও এবার নতুন সরকার ক্ষমতায় থাকায় তা সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে।

এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি-বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সরকারের মতোই লোডশেডিং কমানোর জন্য তিন সপ্তাহ সময় চেয়েছেন।

যদিও তিন সপ্তাহ পর ভাদ্র মাসের রোদের প্রখরতা কমে আসায়, তাপমাত্রা কমবে বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদফতর। তাদের তথ্য বলছে, বছরের আশ্বিন (সেপ্টেম্বর) মাস থেকে বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসায় লোডশেডিংও কমতে শুরু করে।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেকসই বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা নিয়ে সংকট থেকেই যাচ্ছে। শীতে গ্রীষ্মের মতো সংকট না হলেও আগামী বছরের শুরু থেকেই বিদ্যুতে বড় ধাক্কা সইতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বল্প মেয়াদে জ্বালানি সংস্থানের চিন্তা না করে সাবেক সরকার একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এসব কয়লা এবং গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় অংশই আমদানি নির্ভর।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বিবেচনা করলে, কয়লা এবং এলএনজির আমদানি ব্যয় যেহেতু ডলারে পরিশোধ করতে হয়, তাই সরকারের সামনে সংকট সামাল দেওয়ার একমাত্র উপায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো। কারণ, এখন জ্বালানি ব্যয়ের পুরোটাই রিজার্ভ থেকে নিয়ে খরচ করতে হয়।

তবে সেটি করাও সরকারের পক্ষে খুব সহজ নয় বলে মনে করা হচ্ছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে সংকট কাটানোর কোনও সুযোগ নেই। তবে প্রতি বছর এপ্রিল ও সেপ্টেম্বরে এসে আমাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি হয়। গরমে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ফলে গত কয়েক বছর ধরেই আমরা এ সংকটের মাঝে আছি।’ তিনি বলেন,  ‘এটা কাটিয়ে উঠতে হলে সবার আগে দরকার পূর্ব প্রস্তুতি।  আমাদের আগে থেকেই এপ্রিল ও সেপ্টেম্বরের জন্য বাড়তি চাহিদা পূরণের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে এবং সে অনুযায়ী জ্বালানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’

ড. ইজাজ হোসেন আরও বলেন, ‘আমদানি-নির্ভরতা দুই-একদিনে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না। সেজন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ অন্তত এখনকার চেয়ে ১০ গুণ বাড়াতে হবে।’

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দিনের বেলায়ও এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। সরকারের হিসাবে এক হাজার মেগাওয়াট হলেও বাস্তবে এর পরিমাণ দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বলে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) পিজিসিবি জানায়, দুপুর ১২টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট,  উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ২৬০ মেগাওয়াট,  আর লোডশেডিং ছিল ১১৮৪ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ সংকট ও লোডশেডিংয়ের বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, ‘আমরা জ্বালানি সংকট বিবেচনা করেই আমদানির পরিকল্পনায় গিয়েছি। এত দ্রুত সেই জায়গা থেকে ফেরা সম্ভব না। তবে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ বাড়ানো এবং পরিবেশের কথা বিবেচনা করে হলেও নতুন প্রযুক্তিতে কয়লার ক্ষেত্রেও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের চাহিদা কী পরিমাণ বাড়তে পারে, তা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী কাজ শুরু করা যেতে পারে।’

কয়লা, এলএনজি ও তেল, সবই আমদানি-নির্ভর

দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মোট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয় গড়ে ১ হাজার ঘনফুট। এদিকে দেশে মোট গ্যাসের চাহিদা ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুট।  এরমধ্যে সরবরাহ করা হয় ২৮০০ থেকে ২৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি বিদেশে থেকে আমদানি করা হয়।

এছাড়া দেশে এখন ৬ হাজার ১১০ মেগাওয়াটের কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। ভারতের আদানির কয়লার দামও বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। শুধু বড়পুকুরিয়া ছাড়া সব কয়লা আমদানি করা হয়।

এদিকে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেলের যে চাহিদা আছে, তারও বেশিরভাগ আমদানিনির্ভর।

বিপিসি জানায়, সব মিলিয়ে বছরে বিপিসির ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল লাগে। এর মধ্যে দেশের একমাত্র পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ টন। বাকিটা সরাসরি আমদানি করা হয়। জানা গেছে, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ডিজেল। আর ডিজেলের ৮০ শতাংশ সরাসরি আমদানি করা হয়।