একটি সত্যিকারের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ দেশের লক্ষ্যে

একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশে, এমন একটি পরিবেশ এবং সংস্কৃতি বিরাজ করে, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক তার নিজ পরিচয়, নিজ সংস্কৃতি, নিজ শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা উভয় নিয়েই সদর্পে জীবনযাপন করতে পারেন। নাগরিকদের অর্থপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হলে তার নিজস্বতা এবং স্বতন্ত্রতা এই উভয়ের সংশ্লিষ্ট চাহিদা পূরণ করা বাঞ্ছনীয়। একটি সত্যিকারে অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ তৈরির অর্থ হলো, প্রত্যেকে যেন অনুভব করতে পারে যে তারা তাদের নিজ নিজ পরিচয় এবং স্বতন্ত্রতা নিয়েই মূল্যায়িত এবং এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যটি সংরক্ষিত। এই ভারসাম্যের ব্যত্যয় ঘটে যখন একজন ব্যক্তি অনুভব করে যে তার স্বতন্ত্রতার প্রতি কোনও কম সম্মান এবং কম গ্রহণযোগ্যতা দেখানো হয়। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশে প্রত্যেক ব্যক্তির অনন্য গুণাবলি শনাক্ত করা হয় এবং সমাজ, নাগরিকদের পারস্পরিক আত্মীয়তার বোধকে উৎসাহিত করে।

বিশ্বকে একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ মানে উন্নীত করার জন্য, ইক্যুয়াল রাইটস ট্রাস্ট, লন্ডনে অক্টোবর ২০০৮-এ সমতার নীতির ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করে। প্রথমবারের মতো, এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার দলিল হিসেবে “সমতার” মৌলিক নীতিগুলো প্রতিষ্ঠা করে। এই “সমতার অধিকার”-এর বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে—(১) প্রতিটি মানুষের সমান মূল্য এবং সমান মর্যাদার স্বীকৃতির অধিকার; (২) আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার; (৩) সমান সুরক্ষা এবং সুবিধা পাওয়ার আইনগত অধিকার; (৪) অন্য সবার মতো একই সম্মান এবং বৈষম্যহীনভাবে আচরণ প্রাপ্তির অধিকার; এবং (৫) অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা নাগরিক জীবনের যেকোনও ক্ষেত্রে অন্য আর সবার সঙ্গে সমতা ও সাম্যের ভিত্তিতে অংশগ্রহণের অধিকার।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১ ঘোষণা করেছে যে সব মানুষ স্বাধীন এবং সমান মর্যাদা এবং সমান অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। যেমনটি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদেও স্বীকৃত। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদের ২৬ অনুচ্ছেদ বৈষম্যহীনতার অধিকারকে একটি স্বায়ত্তশাসিত মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং এই অধিকারটি উপলব্ধি করার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে পারস্পরিক সম-দায়বদ্ধতার সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭), শুধুমাত্র লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্য না করার গ্যারান্টি (অনুচ্ছেদ ২৮.১, অনুচ্ছেদ ২৮.৩), নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ বিধান (অনুচ্ছেদ ২৮.৪) এবং সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগের নিশ্চয়তা রয়েছে (ধারা ২৯.১)।

বাংলাদেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সব পর্যায়ে সমান অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। তারপরও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের কোনও সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। বিদ্যমান আইন, নীতি এবং এই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দায়-এর প্রতিশ্রুতি সব নাগরিকদের জন্য সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা দেয়। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ গঠনে এসব আইন ও নীতি বাস্তবায়ন ও প্রয়োগে বর্তমান সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভুললে চলবে না যে নাগরিকদের “মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা” সমাজে এবং দেশে তার সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তির প্রধান ভিত্তি। যেখানে কেউই প্রান্তিক বোধ না করে বা কোনোভাবে আক্রান্ত না হয়ে তার মতামত প্রকাশ করতে নিরাপদ বোধ করে। একটি দেশে অন্তর্ভুক্তি যত বেশি হবে, মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তার প্রয়োজন তত বেশি হবে। উইলিয়াম কান একে বলেছেন – ‘স্বতন্ত্রতা, মর্যাদা বা ক্যারিয়ারের নেতিবাচক পরিণতির ভয় ছাড়াই যে কেউ নিজেকে প্রকাশ করতে পারার অভিজ্ঞতা’ (১৯৯০)। মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তার ওপর এই জোর নিশ্চিত করে যে প্রত্যেকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে নিরাপদ এবং মূল্যবান বোধ করবে।

টিম ক্লার্ক, দ্য ফোর স্টেজ অব সাইকোলজিক্যাল সেফটি (২০২০)-তে এর পর্যায়গুলোকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথমে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ক্ষেত্রে কোনও বাধা ছাড়াই অংশ নিতে এবং প্রয়োজনে নেতৃত্ব দিতে পারে। এবং এরপর পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি যে সবার সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে, বাংলাদেশ শিগগিরই একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাজে পরিণত হবে, ঠিক যেমনটা কল্পনা করেছে, করছে আমাদের ছাত্র এবং নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ মনন।

লেখক: আইনজীবী এবং সামাজিক-আইন গবেষক।