সালাউদ্দিনের ১৬ বছরের শাসনামলে কেমন ছিল বাংলাদেশের ফুটবল?

খেলোয়াড় থেকে কোচ হওয়ার পর কাজী সালাউদ্দিন একসময়  সংগঠক হবেন, তা হয়তো তিনি ভাবেননি। কিন্তু ভাগ্য তাকে ফুটবলের মসনদ তথা বাফুফের সভাপতি পদে ঠিকই বসিয়েছে। হঠাৎ করে ২০০৩ সালে বাফুফের সহ-সভাপতি হয়ে সংগঠক রুপে আবির্ভাব। ঠিক তেমনই দুই বছরের মাথায় পদত্যাগ করে হঠাৎ একদিন সভাপতি পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে জিতেও গেলেন। ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এরপর সভাপতির ‘গরম চেয়ারে’ বসে কতশত আশার ফুলকি ছড়িয়ে কত বেলা কেটেছে। ঠিক ১৬ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে হঠাৎ পঞ্চম মেয়াদের নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই সময়ে আশার বেলুন যেমন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করেছেন, তেমনই দেশের ফুটবলে ব্যর্থতার ধারক-বাহক হয়ে থাকবেন।

সভাপতি হয়েই চমক, তবে…

২০০৮ সালে কঠিন এক নির্বাচন করে বাফুফে সভাপতি পদে এসে কাজী সালাউদ্দিন যেন একের পর এক চমক দেখাতে লাগলেন। সিটিসেল-গ্রামীনফোন-নকিয়ার মতো বড়সড় কোম্পানিদের স্পন্সর করে আনলেন। কোটি কোটি টাকার স্পন্সরশিপ এনে ফুটবলকে খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধতে লাগলেন।

তিনি আসার আগে ঠিক বাফুফে ভবনে ফুটবলাররা খেলার কারণে আন্দোলন-সমাবেশ করেছিলেন। সালাউদ্দিন এসে বড় কোম্পানির স্পন্সর এনে প্রিমিয়ার লিগ মাঠে নামালেন। অদ্যাবধি তা এখনও নিয়মিত চলছে। মাঝে কোটি টাকার সুপার কাপ করে মাঠে দারুণভাবে দর্শক ফিরিয়ে আনলেন। সেটারও অপমৃত্যু হতে সময় লাগেনি।

সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় লিগই শুধু নিয়মিত করেছেন। আবার ঢাকার নিচের দিকে খেলা কিংবা ঢাকার বাইরের খেলার দিকে জোর দেননি। অনিয়মিত হয়ে আছে। বিশেষ করে জেলা লিগগুলো। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ কিংবা স্কুল ফুটবল। যার কারণে সেভাবে ভালো ফুটবলারও বেরিয়ে আসেনি।

পেশাদার লিগ নামে মাত্র হলেও তাতে কোনও কাঠামো সেভাবে তৈরি করতে পারেননি। ক্লাবগুলো শুধু খেলেই যাচ্ছে। একটি বা দুটি ক্লাব দিয়ে কেউই সেই অর্থে পেশাদার হতে পারেনি। না আছে তাদের কাঠামো, না আছে পুরোপুরি ফুটবল সংস্কৃতি। বর্তমানে এমন অবস্থায় ঢাকা লিগ বলে চালিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। 

মেসিদের ঢাকায় খেলা ও ঋণ

সালাউদ্দিন মানে চমক। শুরু থেকে তেমনটি করে দেখিয়েছেন। ২০১১ সালে মেসির আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার মধ্যে প্রীতি ম্যাচ ঢাকায় আয়োজন করে বড় চমক দেখান। কিন্তু সেই আয়োজনে কোটি কোটি টাকার ঋণ এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বাফুফেকে। যার কারণে সমালোচনাও কম হচ্ছে না। 

ফিফা থেকে একাডেমি পেয়েও হারানো

সিলেটে বিকেএসপিতে প্রথমবারের মতো বাফুফের একাডেমি হয়েছিল। ফিফা এর পেছনে প্রায় ৭ কোটি টাকা দিয়েছিল। কিন্তু বছরখানেক সময় চলতে না চলতে তা মুখ থুবড়ে পড়ে। দেনায় জর্জরিত হয়ে সেই একাডেমিও হারাতে হয়েছে। গুঞ্জন আছে ফিফা থেকে এত টাকা পেয়েও তা ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়নি। যার কারণে পরবর্তীতে আর কোনও একাডেমি বাংলাদেশে করা যায়নি!

কমলাপুরে নামকাওয়াস্তে ট্রেনিং একাডেমি করলেও তাতে নেই আধুনিক সুযোগ সুবিধা। তবে বাফুফে ভবনে জিমন্যাসিয়ামটি সুদৃশ্যমান।

নারীদের সাফল্য, ছেলেদের ব্যর্থতা, ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ভরাডুবি, কোচ বদল

এই তো কয়েক বছর আগে মেয়েরা প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতে ছাদখোলা সংবর্ধনা পেলো। বাফুফে ভবনে সারা বছর মেয়েদের রেখে সাফল্য এসেছে। তবে দেশব্যাপী নারী ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি। এই খাতে অনেক অর্থ আসলেও তা ঠিকমতো মিডিয়ার কাছে বলাও হতো না। মেয়েদের সুযোগ সুবিধা নিয়ে মাঝে মধ্যেই নানান অভিযোগ উড়ে বেড়াতো।  মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলতে না যাওয়ায় বরং সালাউদ্দিন চরম সমালোচনার মধ্যে পড়েন।

মেয়েরা তাও সফল হয়েছে। ছেলেরা তার আমলে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলে শুধু এবারই বেঙ্গালুরুতে সেমিফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছে। আর অন্য চার আসরে গ্রুপ পর্ব থেকে ব্যর্থতা নিয়ে ফিরতে হয়েছে। দেশের ফুটবল মাঝে মধ্যে সাফল্য পেলেও তা ধরে রাখা যায়নি। অনেকটা ফ্লুকের মতো। তার শাসনামলে ২২ জন কোচ বদল হয়েছে। এর কারণে অনেক অর্থও ক্ষতিপূরণও দিতে হয়েছে। তবে জাতীয় দলের সুযোগ সুবিধা বেড়েছে। তারকা হোটেলে রেখে অনুশীলন। কিংবা দেশের বাইরে গিয়ে প্রস্তুতি সবই তার সময়ে।

২০০৮ সালে সালাউদ্দিনের সময় বাংলাদেশ র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৮০ তে ছিল। তা কমতে কমতে একসময় ১৯৭-তে নামে। পুচকে ভুটানের কাছে হেরে নির্বাসনে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। বর্তমানে তো ১৮৪ র‌্যাঙ্কিং নিয়ে খাবি খাচ্ছে জামাল ভূঁইয়ারা।

সবমিলিয়ে সালাউদ্দিনের আমলে বঙ্গবন্ধু কাপ, বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাই, এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ, মারদেকা কাপ, চার জাতি আসর, রয়্যাল চ্যালেঞ্জ কাপ, ফিফা ফ্রেন্ডলি- এসব মিলিয়ে গত ১৬ বছরে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ খেলেছে মোট ১২৮টি ম্যাচ। এর মধ্যে মাত্র ৩৩টি ম্যাচে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ! ড্র করেছে ৩৪ ম্যাচ। বাকি ৬১ ম্যাচেই হেরেছে বাংলাদেশ।

আবু নাঈম সোহাগ

সোহাগ-সালাম মুর্শেদীর ওপর ফিফার খড়গ

আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে গত বছর এপ্রিলে বাফুফের বিরুদ্ধে ফিফা কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে। বাফুফের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ দুর্নীতির কারণে দুই বছর নিষিদ্ধ হয়েছেন, পরবর্তীতে তার শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়ে। তাকে বাফুফে থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও সোহাগ দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেও অন্য জগতে বেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন! 

বাফুফের ফিন্যান্স কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদীকে ফিফা ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। যা বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে প্রথম। যদিও সালাম মুর্শেদী নতুন সরকার আসার পর পদত্যাগ করেছেন।

এর আগেই বাফুফেতে আর্থিক অনিয়মের অনেক অভিযোগ তুলেছিলেন প্রয়াত সাবেক তারকা ফুটবলার ও সাবেক সহসভাপতি বাদল রায়। অস্বচ্ছতার নানা প্রশ্ন তুলে নির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ হোসেন মুন। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বাফুফেকে ১০ কোটি টাকার অনুদান দিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকার হিসাব ঠিকমতো না দেওয়ায় পরবর্তীতে আর বাকি ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়নি।

শেষ কথা

সালাউদ্দিন দেশের ক্রীড়ামোদিদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবে স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। মাঠের খেলাতে কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন। সংগঠক হয়ে ব্যর্থতার কালিমা নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে। ২৬ অক্টোবর বাফুফেতে নির্বাচন। এরপর থেকে সালাউদ্দিন বাফুফেতে অতীত। তবে তাকে নিয়ে চর্চা যে বহুদিন থাকবে তা বলাই যায়। এক স্বপ্নবাজ এসে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দেশের ফুটবলকে যে জাগাতে পারেননি!