ফিরে দেখা ৪৫ বছরের ইতিহাস

সম্প্রতি ‘মাইলস’র প্রাক্তন ভোকাল এবং বেজিস্ট শাফিন আহমেদের অকাল মৃত্যুর সংবাদে বেশ কিছু ভুল তথ্য লক্ষ্য করেছেন ব্যান্ডের বর্তমান ও প্রাক্তন সদস্যরা। সেই ভুল শুধরানোর লক্ষ্যে ব্যান্ডের সদস্যদের দেওয়া তথ্য নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক ইতিহাসটি তুলে ধরা হলো-

ফরিদ রশিদের উদ্যোগে ১৯৭৯ সালে আত্মপ্রকাশ করে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস। সূচনায় এই ব্যান্ডের সদস্যরা ছিলেন ফরিদ রশিদ (বেজ ও ভোকাল), কামাল মাইনুদ্দিন (ড্রামস), মুসা রহমান (বেজ), রবিন (কিবোর্ড ও ভোকাল), ইশতিয়াক রহমান (লিড গিটার) ও হ্যাপি আখন্দ (কিবোর্ড)।

১৯৮০ সালে ইশতিয়াক রহমান ব্যান্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার পর হামিন আহমেদ (গিটার ও ভোকাল) যোগ দেন। এর কয়েক মাস পরে, একই বছর ব্যান্ডে যোগ দেন শাফিন আহমেদ (রিদম গিটার ও ভোকাল)।
 
১৯৮১ সালে ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান রবিন। পরের বছর দলে আসেন মানাম আহমেদ (কিবোর্ডস)। ঐ সময়ে হ্যাপি আখন্দ দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনিও ব্যান্ড ছেড়ে দেন।

১৯৮২ সালে বিটিভিতে মাইলস একটি যন্ত্রসংগীতের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। এই অনুষ্ঠানে পরিবেশিত যন্ত্রসংগীতগুলো এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, পরবর্তী সময়ে মিউজিকগুলো বিটিভিতে ফিলার মিউজিক হিসেবে বহু বছর বাজানো হয়। টেলিভিশনে পারফরমেন্সের পর, ব্যাপক চাহিদা বিবেচনায় মাইলস ব্যান্ড শিল্পকলা মিলনায়তনে একটি পাবলিক কনসার্টে অংশ নেয়। একই বছর ব্যান্ডটি (ফরিদ, কামাল, হামিন, শাফিন ও মানাম) ‘মাইলস’ শিরোনামে একটি ইংরেজি কাভার অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করে। 

১৯৮৩ সালে শাফিন আহমেদ ব্যক্তিগত কারণে ব্যান্ড ছেড়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান। এরপর মাইলস ব্যান্ডের চার সদস্য ফরিদ রশীদ, কামাল মঈনুদ্দিন, হামিন আহমেদ ও মানাম আহমেদ ব্যান্ডের কার্যক্রম চালাতে থাকেন। 

৪৫ বছরে মাইলস-এর অ্যালবামগুলো

মাইলস (ইংরেজি কাভার) (১৯৮২)

আ স্টেপ ফার্দার (ইংরেজি) (১৯৮৬)

প্রতিশ্রুতি (১৯৯২)

প্রত্যাশা (১৯৯৩)

প্রত্যয় (১৯৯৬)

প্রয়াস (১৯৯৭)

প্রবাহ (২০০০)

প্রতিধ্বনি (২০০৬)

প্রতিচ্ছবি (২০১৫)

১৯৮৬ সালে ব্যান্ডটি তাদের দ্বিতীয় ইংরেজি অডিও অ্যালবাম ‘আ স্টেপ ফার্দার’ প্রকাশ করে। ঐ বছর ফরিদ রশিদও ব্যক্তিগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তখন মানাম আহমেদের ভাই খৈয়াম আহমেদ (বেজ) যোগ দেন। এর বছরখানেক পর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান কামাল মঈনুদ্দিনও। সেই সময় মিল্টন আকবর (ড্রামস) ব্যান্ডে যোগ দেন।

১৯৮৯ সালে ব্যক্তিগত কারণে খৈয়াম আহমেদও ব্যান্ড ছেড়ে দেন। ১৯৯০ সালে শাফিন আহমেদ যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে আসলে পুনরায় ভোকাল এবং বেজ হিসাবে তাকে ব্যান্ডে নেয়া হয়। মাইলস সেসময় একটি বাংলা অ্যালবাম রেকর্ডিংয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

১৯৯১ সাল থেকে হামিন আহমেদ, মানাম আহমেদ, মিল্টন আকবর ও শাফিন আহমেদ এই চারজনে মিলেই মাইলস ব্যান্ডকে নতুন করে এগিয়ে নেন। ১৯৯২ সালে প্রথম বাংলা অ্যালবাম ‘প্রতিশ্রুতি’ প্রকাশিত হয়। সেই অ্যালবামেরই বহুল আলোচিত ‘চাঁদ তারা’ গানটি (মানাম আহমেদের সুরে, শাফিন আহমেদের কণ্ঠে) ফিরোজ মাহমুদের প্রযোজনায় বিটিভির ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়, যা পরবর্তীতে দেশজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর থেকে মাইলসকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

পরবর্তীতে মিল্টন আকবর ব্যক্তিগত কারণে ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে মাহবুব রশিদ (ড্রামস) যোগ দেন। এরপর মাইলস একের পর এক বাংলা অ্যালবাম প্রকাশ করতে থাকে এবং প্রত্যেকটি অ্যালবাম আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা লাভ করে।

মাঝে ১৯৯৫ সালে মাহবুব রশিদ দল ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান, মাইলস ব্যান্ডও ১৯৯৬ সালে প্রচুর জনপ্রিয়তার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সংগীত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য সফরে যায়। একই বছর সৈয়দ জিয়াউর রহমান তূর্য (ড্রামস) ব্যান্ডে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে সৈয়দ ইকবাল আসিফ জুয়েল (গিটার) ব্যান্ডে যোগ দেন। আর এভাবেই মাইলস দল দেশে ও বিদেশে অগণিত ভক্তদের গানে গানে মনোরঞ্জন করে চলছে। 

মাইলস দলে মানাম আহমেদের সুরে শাফিন আহমেদের কণ্ঠের গানগুলো একের পর এক মাইলফলক স্থাপন করতে থাকে। উল্লেখযোগ্য গানগুলো ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘ধিকি ধিকি’, ‘চাঁদতারা’, জ্বালা জ্বালা’, ‘পিয়াসী মন’, ‘ভুলব না তোমাকে’, ‘তোমার আশায়’, ‘স্বপ্নভঙ্গ’ ইত্যাদি।  এবং হামিন আহমেদের কণ্ঠে ‘হৃদয়হীনা’, ‘প্রিয়তমা মেঘ’ ইত্যাদি।

এখানে আরও উল্লেখ্য, শাফিন আহমেদের সুরে ‘প্রথম প্রেমের মত’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’, ‘জাদু’, ‘দরদিয়া’, ‘জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন’, ‘পলাশীর প্রান্তর’ এবং হামিন আহমেদের সুরে ‘নীলা’, ‘সুপ্ত বাসনা’, ‘এ সময়’, ‘শান্তি নাই’, ‘শেষ ঠিকানা’, ‘শান্তি চাই’, ‘আচেনা জীবন’সহ এমন আরও অনেক গান বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

মাঝে দুইবার শাফিন আহমেদ মাইলস ছেড়ে একক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবার ফিরে আসেন। ২০১৯ সালে শেষের দিকে তৃতীয় বারের মতো শাফিন আহমেদ ব্যক্তিগত কারণে স্থায়ীভাবে মাইলস ত্যাগ করেন এবং নিজস্ব একটি ব্যান্ড গঠন করেন।

মাইলস ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপ এমন- হামিন আহমেদ (ভোকাল ও গিটার), মানাম আহমেদ (কিবোর্ডস, কম্পোজিশন ও ভোকাল), সৈয়দ জিয়াউর রহমান তূর্য (ড্রামস) ও সৈয়দ ইকবাল আসিফ জুয়েল (গিটার)।

মাইলস ব্যান্ডের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় ৫ বছর আগেই শাফিন আহমেদ দল ছেড়ে গড়েছেন ‘ভয়েস অব মাইলস’।

এদিকে শাফিন আহমেদের প্রথম জানাজা হয়ে গেছে গত শুক্রবার (২৬ জুলাই), যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি মসজিদে। এবার মাতৃভূমিতে ফেরার পালা, ‘তুলনাহীন’ তারকা শাফিন আহমেদের মরদেহ।

হামিন আহমেদ জানিয়েছেন, সোমবার (২৯ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৫টায় ঢাকা বিমানবন্দরে নামার কথা রয়েছে শিল্পীর নিথর দেহটি। পরদিন মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বাদজোহর গুলশান আজাদ মসজিদে হবে জানাজা। এরপর বনানী কবরস্থানে হবে দাফন। যেখানে শায়িত আছেন শাফিন আহমেদের বাবা সংগীতগুরু কমল দাশ গুপ্ত এবং মা কিংবদন্তি নজরুলশিল্পী ফিরোজা বেগম।

পরিবারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হরা হয়েছে কুলখানির বিষয়েও। শাফিন আহমেদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় কুলখানি হবে শুক্রবার (২ আগস্ট) জুমার নামাজের পর বনানী কবরস্থানের পাশে গুলশান কমিউনিটি মসজিদে।

বলা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের গান শোনাতে গত ৯ জুলাই ঢাকা থেকে উড়ে গেছেন শাফিন আহমেদ। দ্বিতীয় কনসার্ট ছিলো ২০ জুলাই, ভার্জিনিয়ায়। সেই শোয়ের মঞ্চে ওঠার খানিক আগেই হোটেল রুমে লুটিয়ে পড়েন ৬৩ বসন্তের এই রকার। হাসপাতালে ভর্তি, লাইফ সাপোর্ট এবং ২৫ জুলাই বাংলাদেশ সময় ঠিক ভোর ৬টা ৯ মিনিটে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

তার এই অকাল প্রস্থানে রেখে গেছেন দুই বড় ভাই তাহসিন ও হামিন, স্ত্রী ডা. রুমানা দৌলা, তিন পুত্র মাইসিম, আজরাফ ও রেহান এবং এক কন্যা রানিয়াকে। সঙ্গে অগুনতি ভক্ত-বন্ধু-স্বজন।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে হার্টের অসুখে ভুগছিলেন শাফিন আহমেদ। ১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা শিল্পী। শাফিন আহমেদ