জামায়াতকে নিষিদ্ধের প্রতিবাদ জানালো বিএনপি

জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। দলটি মনে করে, ‘আন্তর্জাতিক মানের ন্যায়সংগত ও বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ কোনও তদন্ত ছাড়াই কোনও রাজনৈতিক দলকে অপবাদ দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা অন্যায় এবং সংবিধানসম্মত নয়।’

বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার দিকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতিতে এসব কথা বলেন।

‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ’ শীর্ষক শিরোনামে বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিতে ন্যায়সংগত আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে গিয়ে যে হত্যাযজ্ঞ করেছে, তা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরল। এই হত্যাযজ্ঞ তথা গণহত্যার দায় থেকে নিজেদের আড়াল করতে গণবিরোধী সরকার তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে কতগুলো প্রতিষ্ঠানে ন্যক্কারজনক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে উল্টো এসবের দায় বিরোধী দলের ওপর চাপানোর ষড়যন্ত্র করছে।’

বিএনপি মহাসচিব উল্লেখ করে বলেন, ‘কোনও ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। তাদের নির্দেশে, পরিকল্পনায় বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে। সরকার এর দায় বিএনসিহ অন্যান্য বিরোধীর ওপর চাপানোর অপউদ্দেশ্যে দলের সিনিয়র নেতা এবং কর্মীসহ ১১ হাজার নিরপরাধ ছাত্র-জনতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে, অনেক নেতাকর্মী গুম হয়েছেন, রিমান্ডের নামে ও কারাগারেও তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যখন এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পদত্যাগের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন ও চাপে রাখতে বিশ্বাসযোগ্য কোনও তদন্ত ছাড়াই নিজেদের দায়দায়িত্ব বিরোধী দলের ওপর চাপানোর অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিন্দনীয়, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক।’

‘ছাত্র আন্দোলনে বর্বরোচিত গণহত্যার দায়ে আওয়ামী সরকারের পদত্যাগের চলমান ইস্যুকে ধামাচাপা দিতে নতুন বিতর্ক, নতুন ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে, যা বুমেরাং হতে বাধ্য। পরিকল্পিতভাবে নন-ইস্যুকে ইস্যু বানানোর পুরাতন কার্ড নতুন করে খেলে আওয়ামী লীগ জনদৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারবে না। শত শত ছাত্র, কিশোর, যুবক, শিশুসহ জনতার রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না,’ যোগ করেন ফখরুল।

পরিস্থিতি আরও জটিল করবে আ.লীগ
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এসব হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেরা পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি আরও জটিল ও সংঘাতময় করে তার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপানোর আশঙ্কা করছে দেশবাসী। অতীতেও তারা নিজেরা সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে। চলমান আন্দোলনেও তা-ই করছে।’

ফখরুল বলেন, ‘বিরোধী দল-মতকে নির্মূল করে বিরোধী দলশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রঘাতী আওয়ামী লীগ তা ভবিষ্যতেও করতে পারে। এ জন্য দেশবাসী ও রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানাই।’

‘হয় সঙ্গী, না হয় জঙ্গি’ নীতিতে বিশ্বাসী আ.লীগ
বিবৃতিতে ফখরুল বলেন, ‘বহুদলীয় ব্যবস্থায় একেকটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন নীতি, আদর্শ, কর্মসূচি থাকাটাই স্বাভাবিক। বল বা শক্তি প্রয়োগ না করে উন্মুক্ত রজনীতির ময়দানে জনগণের সমর্থনে রাজনৈতিকভাবে তা শান্তিপূর্ণ মোকাবিলা করাই রাজনৈতিক দলের কাজ। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে বা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে নির্মূল বা ধ্বংস কিংবা নিষিদ্ধ করতে সিদ্ধহস্ত।’

‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উন্মুক্ত করা বহুদলীয় রাজনীতির হাত ধরেই বাকশালে বিলীন করা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল বর্তমানে রাজনীতি করছে। বিএনপি কোনও রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ নয়, উন্মুক্ত রাজনীতির ময়দানে জনগণের সমর্থনে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলায় বিশ্বাসী।’

 ‘আওয়ামী লীগ এমন এক রাজনৈতিক দল, তারা ‘হয় সঙ্গী, না হয় জঙ্গি’ নীতিতে বিশ্বাসী। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জাসদকে নির্মূল, ধ্বংস করতে হত্যাযজ্ঞ ও নির্মমভাবে দমন-নিপীড়ন চালিয়েছিল।’

আওয়ামী লীগ জোট বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই জাসদকে আওয়ামী লীগ একসময় তাদের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার প্রেক্ষাপট রচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করতো, সেই জাসদের একেক সময় একেক ভগ্নাংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ এক সময় ১৫-দলীয়, ১৪-দলীয় জোট করেছে, সরকার গঠন করেছে, বর্তমানেও তাদের জোট আছে।’

জামায়াত নেতারা ৩২ নম্বরের বাড়িতে শেখ হাসিনাকে কোরআন ও জায়নামাজ দিয়েছিল
বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিএনপি আজ যাদের নিষিদ্ধ করতে চায়, সেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যও সর্বজনবিদিত। একসময় তারা পরস্পরের সঙ্গী ছিলেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় গণ-আন্দোলনের মধ্যে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করে স্বৈরাচারকে বৈধতা দিতে স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।’

‘সে সময়েও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন নেতারা আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তার পৈতৃক নিবাসে সাক্ষাৎ করে কোরআন ও জায়নামাজ উপহার দিয়েছিলেন। উপহার দেওয়া-নেওয়ার সময় উভয় দলের নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি আজও অনেকের মানসপটে রয়েছে।’

‘৯০-পরবর্তী জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে একত্রে সংসদের ভেতর-বাইরে যুগপৎ আন্দোলনে ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ করেছিল, সংসদ থেকে একত্রে পদত্যাগ করে গণতন্ত্রকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। সে সময় শেখ হাসিনা জামায়াতের নেতাদের পাশে বসিয়ে একত্রে কর্মসূচি দেওয়ার ছবি আজও মানুষের দৃশ্যপটে ভাসে।’

‘তখন জামায়াতে ইসলামীকে তাদের স্বাধীনতাবিরোধী বা জঙ্গি মনে হয়নি। কারণ, তখন জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছিল। আজ জামায়াত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরোধিতা করছে। তারা আজ আওয়ামী লীগের সঙ্গী নেই বলে আওয়ামী ভাষায় জঙ্গি হয়ে গেছে। আজ কোন রাজনৈতিক দল জঙ্গি, তা দেশবাসী ভালো করেই জানে। বাংলাদেশে আজ জঙ্গির সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক আওয়ামী লীগ।’

‘বাংলাদেশের সংবিধানে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন করার অধিকার। এই সাংবিধানিক অধিকারবলে তারা যেকোনও রাজনৈতিক দল, সংগঠন করতেই পারেন’ বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সরকার এসব অগণতান্ত্রিক কাজ করে এক দফা আন্দোলন থেকে জনগণের মনোযোগ সরাতে পারবে না। আমরা দলমত-নির্বিশেষে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সবাইকে রাষ্ট্রঘাতী-প্রাণঘাতী সরকারের পতনের আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি।’

আরও পড়ুন

নিষিদ্ধের প্রতিবাদে জামায়াতের চেয়ে বিএনপি এগিয়ে, মির্জা ফখরুলের দীর্ঘ বিবৃতি