বাড়ছে বেঁচে থাকার দাম, কমছে দাম জীবনের

বাংলাদেশের বাজারে গরু-খাসির মাংস, মুরগী, সকল প্রকার মাছ, ডিম, চাল-ডাল, তেল-চিনি ও লবণ, পিঁয়াজ-মরিচ ও সকল মসলা, প্রায় সব সবজি ও ফলমূলসহ প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম প্রতিবেশী যেকোনও দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বাজারে বেশি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি। আলাদা আলাদা করে লিখতে গেলে লেখার কলেবর বেড়ে যাবে, তাই একটামাত্র পণ্যকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যাক। দেশীয় খামারীদের ব্যবসায়-সুরক্ষা দেওয়ার অযুহাতে গত পনের বছরে গরুর মাংসের বাজার তুলে দেওয়া হয়েছে একটা সিন্ডিকেটের হাতে, ৪০-৪৫ জন খামারী গত পনের বছরে এই পণ্যের দাম ২৫০ টাকা কেজি থেকে ৭৫০-৮৫০ টাকা কেজি পর্যন্ত তুলে দিয়েছে। বছরখানেক আগে ঢাকাসহ কয়েক জেলার স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কয়েকজন কসাই গরুর মাংসের দাম ৫৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছিলেন, সিন্ডিকেটের পাণ্ডারা ‘সরকারি হস্তক্ষেপে’ তাদের বাধ্য করেছে আবার দাম বাড়াতে।

কাঁচাবাজারে দাম কেন বাড়ে?

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ভয়াবহ আকারের এক ‘ফাটকাবাজি’ করেছিলো শেয়ার মার্কেটে। রাতারাতি পথের ফকির বানিয়ে দিয়েছিলো উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত অনেক পরিবারকে। সপ্তাহে ৫০০ টাকা রোজগার করা রিকশাচালকও তার দেড়-দুই বছরের সঞ্চয় খুইয়ে আধা-পাগল হয়ে রাস্তায় পড়ে আহাজারি করেছে – এমন ছবি তখনকার পত্রপত্রিকায় অনেক ছাপা হয়েছিলো। শেয়ার বাজারের এই লুটতরাজ চলেছে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দফা সরকার গঠনের পরও। সেবারও মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত বহু পরিবার নিঃস্ব হয়েছে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে। তারপর তারা সতর্ক হয়ে গেছে। একেবারে এক্সপার্ট ছাড়া স্টক মার্কেটমুখী সচরাচর কাউকে হতে দেখা যায়নি। তখন লুটপাটকারীরা কৌশল বদলেছে। শেয়ার বাজারের মতো ঐচ্ছিক বাজারে এই ‘বেকুব ভেঁড়ার পাল’কে আর টেনে আনতে না পেরে তারা নিজেরাই ঢুকে পড়েছে আমজনতার বাজারে – কাঁচাবাজারে। চাল-তেল-চিনি ইত্যাদি সকল পণ্যের আমদানীকারক ও বাজারজাতকারীদের আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট গড়ে দিয়েছে, যাতে তারা ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নিয়ন্ত্রণ বলতে নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধি ও মুনাফাখোরী। পালা করে একেক পণ্যের দাম একেকবার বাড়িয়ে দিয়েছ তারা। যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণ ছাড়াই ৬০০ টাকা কেজি পিঁয়াজ, ৭০০ টাকা কেজি কাঁচামরিচ কিনতে হয়েছে দেশবাসীকে – প্রতিকারের জন্য সরকার কিছুই করেনি, উল্টো প্রহসন করেছেন ‘দায়িত্বশীল’ মন্ত্রীরা। এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসতেই দেশের বাজারে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাও এক লাফে দেড়শো পারসেন্টের মতো! যার প্রভাব পড়েছে কারখানার উৎপাদন থেকে পরিবহনসহ সকল খাতে।

পরিবহনের কথা উঠলই যখন, এই খাতের নৈরাজ্যের দিকে খানিকটা নজর দেওয়া যাক। এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন যত হয়েছে, ততই অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে পরিবহন-ভাড়া, যাত্রীসেবা ইত্যাদিতে। কেবলমাত্র রাজধানী শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা– এটুকুও সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি, কিংবা রাখতে চায়নি। সিএনজিচালিত অটোরিকশার ক্রয়মূল্য প্রাইভেট কারকে হার মানায়! অথচ এই বাহন সর্বাংশে আমদানিকৃতও নয়। যন্ত্রাংশ আমদানি করে দেশেই সংযোজন হচ্ছে কয়েকটি আলাদা কোম্পানির কারখানায়। তবু এই বাহনের দাম কেন ত্রিশ লাখ টাকা ছুঁই-ছুঁই?

না সিএনজি-অটো, না ট্যাক্সি ক্যাব – কোনও সার্ভিসকেই মিটারে চালানো নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। কালো-নীল ননএসি ক্যাব, হলুদ এসি ক্যাব মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সেনাবাহিনীর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানসহ কয়েকটি কর্পোরেটের মাধ্যমে বিলাসবহুল ক্যাব নামিয়েছে সরকার, যার ভাড়া রেন্ট-এ-কারের ভাড়াকেও হার মানাতো। তবু তারাও কিছুদিন পর মিটারে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে এবং বছর ঘোরার আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। উবার-পাঠাও ইত্যাদি বহুজাতিক অ্যাপ-ভিত্তিক রাইডশেয়ার সার্ভিস এসেছে দেশে, তারাও লংকায় ঢুকে রাবনের নীতিতে গা ভাসাচ্ছে।

বাস-মিনিবাসের কথা তো বলাই বাহুল্য। গ্যাসের দাম বাড়লেও ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া বাড়ে, ডিজেলের দাম বাড়লেও ঢাকা শহরের সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়ে। যা বাড়ে, তা একেবারেই বাড়ে, ডিজেল-সিএনজির দাম কমে গেলেও ভাড়া আর কমে না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন বা বিনা-পরীক্ষায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত অদক্ষ ড্রাইভার, মোড়ে মোড়ে চাঁদাবাজি করা ট্রাফিক ও সরকারি দলের মাস্তান– সবাই মিলে সড়ক পরিবহনে অসহনীয় নৈরাজ্য সৃষ্টি করে রেখেছে বছরের পর বছর। সরকার দৃশ্যমান কোনও প্রতিকারই করেনি বা করতে চায়নি।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় রিকশায় মোটর বসেছে, ব্যাটারির সাহায্যে গতি এসেছে এই বাহনের। কিন্তু যখনই কোনও বাহন যান্ত্রিক শক্তিতে চালিত হবে, তখনই তার চালককে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হবে। সরকার আজ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারেনি। তিন চাকার সিএনজি অটোর প্রায় সমান গতিতে ছোটানো ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইকের চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই কারো। রিকশা বা ভ্যানচালক থেকেই তারা সরাসরি ইজিবাইক ড্রাইভার হয়ে গেছে। প্যাডেল মারার পরিশ্রম দূর হয়েছে, বসে বসেই দারুণ গতি পেয়ে গেছে তারা, কিন্তু সেই গতি সামলানোর মতো দক্ষতা ও দৃঢ়তা নেই কারো হাতে। এদের মধ্যে বেশ কিছু আছে, যেগুলো সনাতন পদ্ধতির রিকশাতেই ব্যাটারি ও মোটর বসিয়ে রূপান্তর করা হয়েছে। এই বাহনগুলোর চালকের বসার ব্যবস্থাও ভারসাম্যপূর্ণ নয়। আগের মতো প্যাডেল মারতে হয় না বিধায় প্যাডেল দুটো খামোখা ঘোরে বা দুলতে থাকে, চালক সেখানে পা রাখে না। তাহলে তারা পা রাখবে কোথায়? সামনের অংশে বেখাপ্পাভাবে পা দুটো তুলে দেয় তারা চাকার দিকে তাক করে, কিংবা রডের দুই দিকে পা ঝোলানোর বদলে এক দিকে পা ঝুলিয়ে তারা চালকের আসনে বসে। ফলে তাদের অবস্থান সবসময় বাম দিকে হেলে থাকে, ভারসাম্য হয় না তাতে। ডানে-বামে ঘোরানোর সময় তাই হিসাবে ভুল করে ফেলে প্রায়ই রিকশা উল্টে যায় বা পাশাপাশি/বিপরীতমুখী রিকশা/বাহনের সাথে ধাক্কা লেগে যায়। … এসব দেখার কেউ নেই। বড় রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা উঠতে দেওয়া হয় না, কিন্তু পাড়া-মহল্লার অলি-গলিগুলোতে এদের অত্যাচারে হাঁটাচলাও করা যায় না।

এই বাহনের আরেকটা বড় সমস্যা হলো, এদের বিদ্যুৎ খরচ। দেশে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও ঢাকার বাইরের অধিকাংশ জনপদে দিনে-রাতে সমানতালে লোডশেডিং হতে থাকে, যার কারণ লক্ষ লক্ষ ইজিবাইকের লাগাতার চার্জ দিতে থাকা।

রাজধানীর গণপরিবহনের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হলো, ট্যাক্সি, সিএনজি, রিকশা, অটোরিকশা/ইজিবাইক – যে বাহনই হোক, চাহিবামাত্র গন্তব্যে নির্দিষ্ট ভাড়ায় তারা যেতে রাজি থাকে না। অন্য যেকোনও দেশের যেকোনও শহরে আপনি ট্যাক্সি বা অটোতে চড়ার আগে বলতে বাধ্য নন যে, আপনি কোন গন্তব্যে যাবেন। সরাসরি উঠে পড়ে চালককে গন্তব্য বলে দিলেই তিনি সেদিকে গাড়ি চালাতে শুরু করেন। চালকের সম্মতির প্রসঙ্গই উঠবে না, কারণ তিনি রাস্তায় নেমে মিটার অন করেছেন মানেই যেকোনও গন্তব্যে যেতে বাধ্য। ভাড়া নিয়েও দরকষাকষির কিছু নেই, কারণ দূরত্ব ও সময় অনুসারে ন্যায্য ভাড়া তো মিটারেই দেখিয়ে দেবে। মিটারের অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ার সাধ্য চালকের নেই। কেউ খুশি হয়ে টিপস দিলে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঢাকা শহরে এই ব্যবস্থা কোনোকালেই কার্যকর করা গেলো না। প্রতিদিন কতশত নাগরিককে যে মিনিটের পর মিনিট, কখনও আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সিএনজিওয়ালাদের রাজি করাতে না পেরে!

গত পনের বছরে জমির দাম বেড়েছে সোনার দামের সাথে পাল্লা দিয়ে। কৃষি জমি কমে এসেছে আশংকাজনক হারে। গ্রামগুলো উন্নয়নের নামে আবাদি জমি হারিয়ে দালানকোঠায় ভরে গেছে। নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে জমির দামের সমানুপাতে। রড, সিমেন্ট, টাইলস ইত্যাদির দাম বেড়েছে নানান কারণে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ইত্যাদির সাথে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরকারি দলের লাগামহীন চাঁদাবাজি– সবই ভূমিকা রেখেছে নির্মাণসামগ্রীর বাজার অস্থিতিশীল করতে। দেশে একের পর এক দৈত্যাকৃতির অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে, বর্ধিত মূল্যে সেসব অবকাঠামোয় নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করেছে যারা, তারা সেই বর্ধিত মূল্য খোলাবাজারেও ধরে রেখেছে। লাভের গুড় চলে গেছে একটা মহলের কাছে, পিঁপড়ের কামড়ে অতীষ্ট জনতা।

শিক্ষার মান যত কমেছে, শিক্ষাব্যয় ততই বাড়তে থেকেছে। প্রাথমিক পর্যায়ের একটি শিশুর পেছনে বাৎসরিক শিক্ষা-ব্যয় এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে দেশের অধিকাংশ নিম্নআয়ের অভিভাবকের পক্ষে সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রাথমিক পার হয়ে যতই উপরে উঠতে থাকবেন, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা-ব্যয় ততই বাড়তে থাকবে। কোচিং, প্রাইভেট টিউশনের সাথে যোগ হয়েছে সপ্তাহে চার-পাঁচটা করে অ্যাসাইনমেন্ট, প্রতিমাসের বেতনের সাথে নানা রকম উন্নয়ন ফি, সপ্তাহে দু-সপ্তাহে সহপাঠী ও শিক্ষকদের নিয়ে আউটডোর ভিজিটের ফি, বছর শেষে ক্লাসপার্টি– কত কত খাত আর কত কত হাত! ছাত্রছাত্রীরা কতটা কী শিখছে কে জানে, অভিভাবকদের শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে। এসব এখন পড়াশোনার বাধ্যতামূলক অংশ, যা ‘কেতাবে নেই, কিন্তু বাস্তবে অনস্বীকার্য’।

এর উল্টোপিঠে, মাদ্রাসা শিক্ষা আরেক হৃদয়-বিদারক অসহায়ত্বের নাম। এবতেদায়ি, কওমী, হাফিজিয়া ইত্যাদি নানান ধরন আছে মাদ্রাসা শিক্ষার। তাদের কোনও কোনোটার পাঠ্যসূচিতে অধুনা বাংলা, ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান, সমাজ, ইত্যাদি বিষয় যুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু তারপরও এই শিক্ষাব্যবস্থা মানসম্মত তো নয়ই, সাধারণ মানের চেয়েও অনেক নিচে অবস্থান করছে। নিখরচায় বা নামমাত্র খরচে পড়াতে পারবেন বলে গ্রাম বা শহরের অতি-দরিদ্র বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের এসব মাদ্রাসার হাওলা করে দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবাসিক ব্যবস্থায়, যাতে বাবা-মার অভাবের সংসার থেকে বেরিয়ে বাচ্চাটা অন্তত কিছু খেয়েপরে বাঁচতে পারে। গ্রাম দেশে এই ব্যবস্থাটাকে সাধারণত ‘আল্লাহর রাস্তায় দিলাম’ বলা হয়, প্রকারান্তরে যা মূলত ‘নিজের রাস্তা নিজেকেই দেখে নিতে বলা’। ফলে, এই বিনাখরচে থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে শিশুকাল থেকেই পথে পথে হাত পেতে মাদ্রাসার জন্য দান-খয়রাত সংগ্রহের নামে ভিক্ষাবৃত্তি শিখতে হয় বাচ্চাগুলোকে। পিতা-মাতা-পারিবারিক পরিবেশহীন এক অমানবিক ও ভালবাসাহীন বৈরী পরিবেশে বড় হতে হয় তাদের। শুরু থেকেই নিজেদেরকে তারা দেশের মূলধারা থেকে পৃথক ও বঞ্চিত, অনাহুত বলে ভাবতে শেখে। … অথচ, এরাও আমাদের মানুষ, আমাদের সন্তান, ভাই-বোন। কিন্তু ব্যবস্থার শিকার হয়ে কখনো কখনো তারা আমাদের মুখোমুখি অবস্থান নিতেও বাধ্য হয় বৈকি!

উচ্চমাধ্যমিক পার হলে পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দোটানা। পাবলিকে খরচ কম, কিন্তু সেশন জট, রাজনীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি সবই আছে– কোথাও কম, কোথাও বেশি। প্রাইভেটে খরচ অনেক, তার চেয়েও বড় কথা দেড়-দুশো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বেশিরভাগই মানহীন, কতগুলোতো ভিত্তিহীন। দেড় দুই সেমিস্টার পার করে ফেলার পর জানা যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুমোদনই নেই!

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো আরেক অপচয়ের নাম! একমাত্র সরকারি এবং দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়, সারা দেশে যার ক্যাম্পাস, কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী – এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম কি আদৌ যুগোপযোগী? দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস বা সমমানের সিজিপিএ নিয়ে পাস করা অনেক ছেলেমেয়েকে চাকরির ইন্টারভিউয়ে বসিয়ে প্রশ্ন করলে হতবাক হয়ে যেতে হয় তাদের জানাশোনার বহর দেখে! অর্থনীতিতে ছদ্মবেকারত্ব বলে একটা টার্ম আছে। যে জমি চাষ করতে পাঁচ জন কৃষিশ্রমিকই যথেষ্ট, সেই জমিতে যদি দশ জন কৃষিশ্রমিক কাজ করে, তাহলে বাড়তি পাঁচজন হলো ছদ্মবেকার। তারা জানেও না তারা বেকার, তাদের নিয়োগদাতারও উপায় নেই তাদের ওই জমিতে কাজ করতে না দিয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষাক্ষেত্রের এক অনিবার্য ‘ছদ্ম-ছাত্রত্ব’।

একে তো খাদ্যপণ্যের আকাশচুম্বি দামের কারণে তারা দৈহিক পুষ্টির চাহিদা থেকে বঞ্চিত। হতদরিদ্র পরিবারগুলো কালেভদ্রে সন্তানদের মাছমাংস খাওয়াতে পারে। গরু-খাসি দূরে থাকুক, ব্রয়লার মুরগীও মাসে দু-তিন দিনের বেশি জোটানো মুশকিল। রুই-কাতলায় হাত দেয়া যায় না, ইলিশ তো আকাশকুসম স্বপ্ন, তেলাপিয়া, চাষের পাঙ্গাস, সিলভার কার্পও হাতের নাগালে আসে না সব সময়। টাটকা সবজি ও ফলমূল জোটে না গরীব ঘরের বাচ্চাদের। শরীরে প্রোটিন, ভিটামিন, ফাইভারের ঘাটতি নিয়েই তারা বেড়ে উঠছে হয় কংকালসার হয়ে, নয়তো বেঢপ মোটা পেট নিয়ে। দৈহিক বিকাশের ঘাটতির সাথে তাদের মানসিক বিকাশের ঘাটতিও যোগ হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষার অভাবে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মানহীন শিক্ষাটাও ‘কিনতে’ ব্যর্থ হওয়ায়। কাদের হাতে আমাদের ভবিষ্যত? আর পনের বিশ বছর পরে কারা দায়িত্ব নেবে এই দেশটা চালানোর? এই অপুষ্টিতে ভোগা অদক্ষ অসমর্থ নাগরিকেরা?

অনেক প্রাণের দামে, অনেক রক্তের মূল্যে নতুন দিন এসেছে। পনের বছরের স্বৈরশাসন, ফ্যাসিবাদ, দুঃশাসন ও শোষণের সরকারকে উৎখাত করা গেছে। সেই দলের সরকার, যাদের পেছনে ছিল পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করার ইতিহাস ও ত্যাগের ঐতিহ্য। মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম ও জনতার ‘ভোট ও ভাতের অধিকার’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৮-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় নিয়ে সরকারে বসার পরপরই তারা জনগণের ভাতের অধিকার হরণ করতে শুরু করেছে খাদ্যপণ্যের বাজারে লুটপাট করতে করতে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে, আর তাদের প্রতিশ্রুত ভোটের অধিকার তো হাস্যকর এক রসিকতা। সেই প্রহসনের হীরকরাজের দুঃশাসন শেষ হয়ে নতুন সরকার এসেছে দেশে।

“বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন”-এর ব্যানারে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এই নতুন সরকার, নতুন ব্যবস্থা। এবার তো আমাদের মুক্তি দিন এই মূল্যস্ফিতি বনাম মূল্যহীনতার বৈষম্য থেকে। দেশের বাজারগুলো থেকে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিন, খাদ্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় আনুন, জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় রাখুন। এবং অতি-অবশ্যই শিক্ষা ক্ষেত্রের বৈষম্য দূর করে এই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনুন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করতে টেকসই ব্যবস্থা নিন। আমাদের জীবন তো এভাবেই বঞ্চিত হতে হতে, প্রতারিত হতে হতে, সুসময়ের মূলো দেখতে দেখতে কেটে যাচ্ছে, কেটে যাবে। অন্তত আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য একটু বাসযোগ্য দেশ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করুন।

লেখক: এনজিওকর্মী ও গীতিকবি

[email protected]