সংবিধান সংস্কার নয়, নতুন গঠনতন্ত্র

সাম্প্রতিক জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনকে ‘ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের বিজয়’ বলে মনে করেন কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার। ধর্মবাদ ও সেক্যুলারবাদের বিভাজন তরুণেরা ভেঙে দিতে পেরেছে— সেই অর্জন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও তিনি মনে করেন, প্রতিবিপ্লব ঘটে গেছে। কারণ, পুরো বিপ্লবটাকে দুর্ভাগ্যক্রমে বঙ্গভবন বা গণভবনে ঢুকানো হয়েছে। এটা এই গণঅভ্যুত্থানের খুব বড় ট্র্যাজেডি। এই সরকারকে চলমান প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে এসে গণঅভ্যুত্থানের সরকারে পরিণত করতে হলে কী করণীয়, অমাদের সামনে এখন নতুন করে গড়ার জায়গাগুলো কী, সেসব নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

বাংলা ট্রিবিউন: কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা ৫ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করলো, সেটা পরবর্তীকালে ১৫ জুলাই থেকে যখন চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে যাচ্ছে, তখন আপনার সঙ্গে কি তাদের যোগাযোগ ছিল?

ফরহাদ মজহার: যোগাযোগ সবসময় ছিল। শুনেছি, পরামর্শ করেছি, যেখানে দরকার হয়েছে বলেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: ওখানে আপনি নিজেকে কোন ভূমিকায় দেখেন?

ফরহাদ মজহার: আপনারা যেমন করে ছিলেন, আর ১০ জন যেভাবে ছিল, সেই ভূমিকাতেই দেখি, অর্থাৎ আমরা নানাভাবে সমাজের নানান স্তর থেকে গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে অংশ গ্রহণ করেছি, সেভাবেই দেখি।

তবে ২০২৩ সালে আমার ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’ বইটি বের হয়। ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’ বইটির একটা প্রভাব সমাজে সব সময়ই ছিল, এর বিক্রি দেখে বুঝি।  তবে ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’ বের হওয়ার পরে তার একটা বিশাল প্রভাব, বিশেষত তরুণদের চিন্তাশীল অংশের মধ্যে লক্ষ্য করেছি। তার মধ্যে ছাত্রদের একটা ছোট গ্রুপ একে হয়তো নিজের মতো আত্মস্থ করতে পেরেছে। তাদের মাঝে সাংঘাতিক প্রভাব পড়েছে।  আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশলগত কথা বলেছি, তারা হয়তো সেটা খেয়াল করেছে এবং ব্যবহার করেছে। অন্যরা অবদানটা ভিন্নভাবে বিভিন্ন দিক থেকে রেখেছে। আসলে গণঅভ্যুত্থানের জন্য জনগণ তৈরি ছিল। একটা বারুদের স্তূপের মতো হাজির ছিল জনগণ। ছাত্ররা দেশলাইয়ের ভূমিকা পালন করেছে, সেটা আর ছাত্রদের মধ্যে সীমিত থাকেনি। লড়াইটা আসলে আদর্শিক ছিল নিশ্চয়, কিন্তু আসল কথা— মূহূর্তটা আগে থেকেই নানান লড়াই ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি ছিল।

বাংলা ট্রিবিউন: এখানে লড়াইটা কী ছিল?

ফরহাদ মজহার: ‘জনগণ’ বর্গটিকে কংক্রিট ফ্যাসিস্ট শক্তিবিরোধী সংগ্রামের জায়গা থেকে বোঝা। বাংলাদেশে সেক্যুলাররা যেভাবে ইসলামকে টার্গেট করে সেক্যুলার বনাম ইসলাম দ্বন্দ্ব বানিয়ে রেখেছিল, সেটা বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠনের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির ছিল। আমরা নিজেদেরকে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে— সেক্যুলার কিংবা ইসলামি জাতিবাদসহ সব ধরনের পরিচয়বাদের ঊর্ধ্বে উঠে— লড়াইটাকে সুনির্দিষ্টভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। জনগণকে সুনির্দিষ্টভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করবার চেষ্টা করে আসছিলাম। আমরা বুঝেছিলাম মতাদর্শিক বিভাজনসহ, অপরাপর ঐক্যবিরোধী বিভেদ ও বিভাজন কাটিয়ে উঠতে হবে। এতে জনগণ সাড়া দিয়েছে। দেখুন, ইন্টারেস্টিং দিক হলো— জনগণ রাজনৈতিক দলের জোটে সেভাবে সাড়া দেয়নি। কিন্তু নির্দলীয় গণজোটে সাড়া দিয়েছে। দলীয় জোটে জনগণ আগ্রহী ছিল না।

দ্বিতীয়ত, ‘ফ্যাসিবাদ’ কী জিনিস তার একটা অভিজ্ঞতাও জনগণের রয়েছে। এর আগে খেয়াল করুন, বাংলাদেশে জামায়াতের বিরুদ্ধে যখন ক্যাম্পেইন চলছিল, তখন কী ধরনের শব্দ ব্যবহার হতো! ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। ফ্যাসিস্ট শব্দটা কিন্তু ‘নির্মূল’— বিরোধী প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা, এই নির্মূলের রাজনীতি একদিকে বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। অপরদিকে সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল।

এই ‘নির্মূল’ শব্দটা এবং তার অন্তর্নিহিত রাজনীতি—  রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশে গঠন করবার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অপরদিকে ‘জামায়াত’ নাম নিয়ে রাজনীতি জারি রাখা বাঙালি ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে শক্তিশালী করবার শর্তও তৈরি করে রেখেছিল। এটার জন্য জাহানারা ইমামকে খুব পছন্দ করলেও ওই কমিটির সঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্ত তাঁকে জানিয়েছিলাম। আমি তো ফ্যাসিস্ট না। এইখানে আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং কৌশলের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য ছিল। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহাদাত চৌধুরীর সঙ্গে পর্যন্ত, নাসিরুদ্দিন ইউসুফদের সঙ্গেও  বন্ধুত্ব হোল না। এই সময়ের যে পলিটিক্যাল অবস্থান সেটা ছিল অপরকে নির্মুল করা। সেটা অবশ্যই ফ্যাসিস্ট। তারা উভয় পক্ষ বাঙালি কিংবা ইসলামি জাতিবাদটা দিয়ে বিভাজন তৈরি করেছে, সেটা আমাদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর থেকে মারাত্মক ক্ষতি করেছে।

বাংলাদেশে ফ্যাসিজম গড়ে উঠছে বাঙালি জাতিবাদের ভিত্তিতে। তারই পাল্টা জাতিবাদ হিসেবে গড়ে উঠছে ইসলামি জাতিবাদ। একটা জাতিবাদের পাল্টা আরেকটা জাতিবাদ গড়ে উঠেছে। আমি কে তুমি কে বাঙালি বাঙালি, আর ওরা বলছে— আমি কে তুমি কে মুসলিম মুসলিম। এইতো তফাৎ। ফ্যাসিবাদের অন্যান্য প্রবণতাও ছিল, কিন্তু এটাই আমাদের জাতীয় রাজনীতির চরিত্র নির্ণয় করেছে।

তাহলে এখানে পলিটিক্যাল প্রশ্নটা কী? আপনি এটাকে নিরসন করবেন কী করে? মীমাংসা কী? এই জিজ্ঞাসাটাই আমার কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার প্রথম পলিটিক্যাল সিরিয়াস ইন্টারভেনশন ছিল— ‘মোকাবিলা’ নামক গ্রন্থ।  মোকাবিলাতে আমি পরিষ্কার বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম—  কার্ল মার্কসের ধর্মসংক্রান্ত প্রস্তাবনা আমরা ক্রিটিকালি পড়িনি। কিন্তু পড়তে হবে। কারণ, ওর মধ্যেই উত্তর নিহিত রয়েছে। বিশেষত কীভাবে ধর্মের মর্ম ও জিজ্ঞাসাকে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পর্যালোচনা করা যায়। মার্কস আমরা ভুলভাবে পাঠ করেছি। ‘মোকাবিলা’ গ্রন্থের মূল আলোচনা ছিল— ধর্মের পর্যালোচনা দরকার। ক্রিটিক দরকার। কারণ, ধর্মের মধ্যে দর্শন থাকে। দর্শনের দুটো রূপ। একটা রূপ ধর্মের মোড়কে হাজির হয়, কারণ ধর্মের মধ্যে চিন্তা হাজির থাকে। আরেক রূপ হাজির থাকে বুদ্ধির মোড়কে— অর্থাৎ বুদ্ধির পরিসরে। সেখানে সত্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কোরআন-হাদিসের দাবি চলে না। বরং কোরআন-হাদিসের সর্বজনীন সত্য যা থাকে, তাকে বুদ্ধির স্বরূপে বা প্রজ্ঞার অভিজ্ঞতা হিসেবে হাজির করাই দস্তুর হয়ে ওঠে। হাজির হয়। দর্শন যখন নিজের চিন্তাকে হাজির করে, তখন সে বাইরের কোনও চিন্তার বরাত দেয় না, ধর্ম বরাত দেয়। যেমন- এটা কেন সত্য? কারণ কোরআনে এই সত্য আছে। ওটা কেন সত্য, কারণ হাদিসে এটা আছে। সত্য আছে ঠিকই, কিন্তু যখন থাকে তার রূপটা ধর্মতাত্ত্বিক।  দর্শনে কিন্তু বরাত দিয়ে কথা বললে হবে না। দর্শনকে দেখাতে হয়— দর্শনের সত্য অনিবার্য (নেসিসারি) এবং সর্বজনীন (ইউনিভার্সাল)। এটাই যুক্তিসঙ্গত। ইউনিভার্সিলিটি ও নেসিসিটি দুটোই দর্শনের ধর্ম।

‘মোকাবিলা’ গ্রন্থে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বকে কীভাবে মোকাবিলা করতে পারি, সেটা দেখালাম। দেখালাম, কাল মার্কস দেখিয়েছেন যে, ধর্মের পর্যালোচনা যদি কোনও সমাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় এবং ধর্মের সত্যকে একটি জনগোষ্ঠীর আত্মবিকাশের মর্মে প্রতিস্থাপিত না করে, তাহলে সেই জনগোষ্ঠী বয়স্ক হয়ে উঠতে পারে না। অর্থাৎ তখন সেই জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রচিন্তাটা বিকশিত হয় না। সমাজে সাধারণভাবে সজীব ও সক্রিয় চিন্তার বিকাশ ঘটে না। তখনই সমাজ নৈতিক, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিকশিত হওয়া শুরু করে, যখন ধর্মের মধ্যে বিশ্ববীক্ষা বা তত্ত্ব থাকে, চিন্তা থাকে, অনুমান থাকে— তাকে দার্শনিকভাবে, মানে বুদ্ধির দ্বারা জনগণকে বোঝানোর বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি আমরা অর্জন করতে সক্ষম হই। তখনই জনগণ বদলাতে শুরু করে। তার ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্যের মধ্যে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠার অনিবার্য ও সর্বজনীন উপাদান জনগণ উপলব্ধি করতে পারে। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী নিজেদের গড়ে তোলার কাজে তখন সহজ ও স্বাভাবিক বিকাশের প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে।  ‘মোকাবিলা’ ছিল আমার নিজের চিন্তার বিকাশের দিক থেকে খুবই নির্ধারক ছেদবিন্দু।

পাশাপাশি দর্শনে আমার আরেকটি যে বিরাট আগ্রহ সেটা ছিল, বাংলাদেশের ফকির লালন বা ফকিরি ধারা। যেটাকে আমি নদীয়ার ভাবান্দোলন বলে থাকি। ভাবান্দোলনটাই বাংলার সত্যিকারের দর্শনের ধারা। শ্রুতি ও কণ্ঠের যে সংস্কৃতি, সেই সাংস্কৃতিক পরিসরে ভাবচর্চাকে উন্নীত করা, তুলে আনা।

লালন নিয়ে ৭০ থেকে ৮০ পর্যন্ত একরকম আগ্রহের জায়গা ছিল, সেটা কাব্যিক আগ্রহের জায়গা। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে এখনও পর্যন্ত আমার ফকিরি জীবন– অর্থাৎ নদীয়ার ভাবান্দোলনের শক্তিশালী ধারা থেকেই আমি বাংলাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম— তার শেকড়ের গভীরতা এবং ভাবের বৈপুল্য আমাকে অভিভূত করলো। শিখলাম। দেখলাম, কীভাবে বাংলা ইসলামের দার্শনিক মর্ম নিজের করে নিয়েছে।  সেখান থেকেই জানলাম, নিজের শক্তিকে কীভাবে উপলব্ধি করতে হয়।

আপনি জানেন, নদীয়া গুরুবাদী। অর্থাৎ বই-কেতাব-গ্রন্থশাস্ত্রবিরোধী। কারণ, মৃত গ্রন্থকে জীবিত মানুষের চিন্তাশীলতা, বিবেক এবং সৃষ্টিশীলতাকে রুদ্ধ করে। নদীয়া বই বা কেতাব পূজা করে না। কারণ, জ্ঞান বা প্রজ্ঞা জীবিত রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে চলে। বই নিজের ব্যাখ্যা নিজে করতে পারে না, সেটা কোনও না কোনও জীবিত মানুষকেই করতে হয়। নদীয়ার ভাবচর্চা বা ফকিরি থেকে আমি সজীব ও সক্রিয় চিন্তার শক্তি ও স্বাদ উপলব্ধি করতে শিখেছি। অর্থাৎ কেতাব বা ছাপাখানার গ্রন্থ না— মানুষই চিন্তা করে, মানুষই অসাধ্য সাধন করে, ইত্যাদি। চিন্তার শক্তির প্রতি আমার প্রবল আস্থা আমি নদীয়ার ভাবচর্চা থেকেই পেয়েছি। পাশ্চাত্য দর্শন থেকে নয়।

আমার গুরু আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছেন। কিন্তু যে বিশেষ শিক্ষায় তিনি বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন, সেটা হলো— সজীব ও সক্রিয় চিন্তায় আস্থা বা বিশ্বাস। শিখিয়েছেন যে, আমার মধ্যে আদৌ যদি কোনও শক্তি থাকে, তাহলে সেটা সমাজে নিশ্চয় ছড়িয়ে যাবে। বিস্ময়করভাবে তিনি আমাকে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে উৎসাহিত করতেন। ফকিরদের মতো আঁচলা নিয়ে ঘোরাননি। সকল প্রকার কাল্টিশ চর্চা থেকে শক্তভাবে দূরে রাখতেন। বলতেন, তুমি যেটা করছো সেটাই তোমার কাজ। অর্থাৎ রাজনীতিই তোমার ক্ষেত্র। আমি বুঝতাম না। কারণ আমি কোনও রাজনৈতিক দলে মোটেও আগ্রহী ছিলাম না। তার কাছে আমি ধৈর্যের শিক্ষা এবং দূরদর্শী হবার সবকটা পেয়েছিলাম। তিনি স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখতে পারা এবং কোন স্বপ্নটা বাস্তবায়ন হবে, আর কোনটা স্রেফ খোয়াব— এই ফারাকও আমি তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: এই যে সরকার আসলো, তাদের পথ এবং গণ-অভ্যুত্থানকে ধারণের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই আপনি বলছিলেন, শপথ নিতে হবে জনগণের সামনে শহীদ মিনারে,  কেন?

ফরহাদ মজহার: আমিতো সেই ব্যাখ্যা দিয়েছি। গণঅভ্যুত্থান হলো জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি।  এর মানে সিম্পল, খুবই সহজ।  জনগণ নিজে স্বয়ং প্রত্যক্ষভাবে হাজির, নিজে বর্তমান। এই যে গণঅভ্যুত্থানে জনগণের স্বয়ং হাজির হয়ে যাওয়া। খোদ বর্তমান হয়ে ওঠা– এটাই গণতন্ত্র। আগের মতো ‘জনগণ’ বিমূর্ত কোনও রাজনৈতিক বর্গ না। লুক্কায়িত নয়, এই জনগণ আইনে নাই, সংবিধানে নাই, কোথাও নাই। কল্পনায় নাই। জনগণ এখন কোনও বিমূর্ত কনসেপ্ট নয়। জনগণ স্বয়ং গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বর্তমান। আইনি সাহিত্যে, আইনি দর্শনে এবং একইসঙ্গে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও সাহিত্যে বা রাজনৈতিক দর্শনে ‘গণের’ এই বর্তমানতাই গণতন্ত্র, গণের তন্ত্র। জনগণ হাজির আছে এবং জনগণের অভিপ্রায়ই চূড়ান্ত, এটাই হাজির হয়ে গেলো।

যখন জনগণ কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্য দিয়ে নয়, বরং নিজেই স্বয়ং হাজির হয়ে যায়, হাজির থাকে, তখন আপনি জনগণের কাছেই তো শপথ নেবেন। আপনি মৃত জিনিসে পুরানা পরিত্যক্ত সংবিধানে কেন শপথ নেবেন।

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনিতো সংবিধান ফেলে দিয়েছেন। তাহলে আবার ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট চুপ্পুর কাছে কেন শপথ নেবেন? আপনি কি সংবিধান দেখে গণঅভ্যুত্থান করেছেন, নাকি সংবিধান ফেলে দেবার জন্য গণঅভ্যুত্থান করেছেন? তাহলে গণঅভ্যুত্থানকে আপনি আবার কেন পরিত্যক্ত সংবিধানের ভেতরে ঢোকাবেন?  তাই বারবার বলেছি, ড. ইউনুস এলে তার উচিত হবে শহীদ মিনারে গিয়ে শপথ নেওয়া।

আসলে কোনও শপথের দরকার পড়ে না। আমি শপথ বলেছি, কারণ সকলে শপথ শপথ করছিল। ইউনূসের দরকার ছিল একটি ঘোষণা, যাকে বলা হয় প্রক্লেমেশান। ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতার ঘোষণা, সেটার শপথ কোথায় গিয়ে নেবে? তখন কি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে শপথ নেবে? এটা অযৌক্তিক। এখানেও তাই। আপনি যে সংবিধানকে বাতিল করে দিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের দ্বারা, সেই সংবিধান মানবেন বলে শপথ নেবেন কেন? তাই আমি বলেছি, একটা গণশপথ বা ঘোষণার ইভেন্ট করার জন্য, যেন বিজয়টা ঐতিহাসিক ঘটনা আকারে হাজির হয়। সেজন্য বলেছি, ড. ইউনূসের উচিত হবে শহীদ মিনারে বা রাজু ভাস্কর্যের সামনে শপথ নেওয়া। যেহেতু গণঅভ্যুত্থানের উৎস ওখানে, ওখান থেকে শুরু। আমি চেয়েছি, তিনি সেখানে গিয়ে ঘোষণা দেবেন। কার কাছে? জনগণের কাছে, যে জনগণ তাকে ‘নির্বাচিত’ করেছে। তাকে আনাটা নির্বাচিত করা। জনগণ রক্ত দিয়ে নির্বাচিত করেছে। ভোট দিয়ে না,  রক্ত দিয়ে নির্বাচিত করেছে। ফলে সেটা না হওয়াটা মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: ক্ষতিটা কোন জায়গায়?

ফরহাদ মজহার: এই যে জীবন্ত গণঅভ্যুত্থান মৃত সংবিধানে ঢুকে গেলো।

বাংলা ট্রিবিউন: সেটা কি ষড়যন্ত্র করে করা হয়েছে?

ফরহাদ মজহার: সেটা আমি জানি না। তবে আমাদের চিন্তার মুশকিল বুঝতে পারি। গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই। রাষ্ট্র গঠন বিষয়ে আমাদের কোনও ধারণা নেই। গণঅভ্যুত্থান কাকে বলে, এটার কী শক্তি, গঠনিক প্রক্রিয়া কী, এই সকল বেসিক রাজনৈতিক অ আ ক খ আমাদের সমাজে কখনও আলোচনা হয়নি। ফলে স্বভাবতই আমার কথাটা অরণ্যে রোদন হয়েছে। এখন তারা শেখ হাসিনার সংবিধানে ঢুকে গিয়ে আর বেরোতে পারছে না। 

বাংলা ট্রিবিউন: এই যে, যেভাবে চাইলেন, তা না করে ওই সংবিধান কাঠামোতে ঢুকে গেলো, তার মধ্যে সংস্কারের বিষয়টা কীভাবে কাজ করবে?

ফরহাদ মজহার: আমি যতগুলো মিটিংয়ে যাচ্ছি সকলে বলছে— আমাদের নতুন গঠনতন্ত্র লাগবে। সংবিধানের সংস্কার চাই না। নতুন গঠনতন্ত্রের কল্পনা, আকাঙ্ক্ষা অভিপ্রায় জনগণের মধ্যে এসে গেছে। জনগণের এই অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য উপদেষ্টা-সরকার চাইলেই ফিরে আসতে পারেন। আপনিতো জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করার জন্য এসেছেন। তাই না?

বাংলা ট্রিবিউন: এখন শপথ হয়ে গেছে এখন কী করে ফিরে আসবে?

ফরহাদ মজহার: আসা সম্ভব। বলতে হবে— একটা রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করেছি, এ সংকট থেকে উত্তরণের একটা পথ আইনের মধ্য দিয়ে থাকতে পারে। আমরা সাংবিধানিক শূন্যতা রাখতে চাইনি। ফলে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি এবং মতামত চেয়েছি। তারা ১০৬ ধারা অনুসারে মতামত দিয়েছেন। এবং সে অনুসারে আমরা শপথ নিয়েছি। এভাবে আমরা একটা অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা সরকার গঠন করেছিলাম। কিন্তু যেহেতু জনগণ নতুন গঠনতন্ত্র চায় এবং আমরা জনগণের পরম অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি, অতএব আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করলাম। একবার শপথ নিয়ে কি আবার ঘোষণা করতে পারে? হ্যাঁ, অবশ্যই পারে। জনগণই নির্ধারক, জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি হিসেবে অবশ্যই পারে। বুঝতে হবে সংবিধানের ছুতা স্রেফ ভাওতাবাজি। জনগণ সঙ্গে থাকলে সব সম্ভব। কারণ, গণতন্ত্রের মূল উৎস জনগণ।

বাংলা ট্রিবিউন: কিন্তু এই যে বললেন, জনগণ এই এই জিনিস চায় বলবেন, এই সরকার কি জনগণের কথা শুনতে পাচ্ছে?

ফরহাদ মজহার: তাদের শোনাটা শুনছেন কিনা বলবো পরে। প্রথমত, আমি মনে করি, সমস্যাটা অন্যত্র। আমরা রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য বুঝি না। ড. ইউনূস রাজনীতিবিদ না, দার্শনিক না। ভুলটা করেছেন প্রথম থেকে আমি যখন এ কথাগুলো বলছি, এবং তার পক্ষে জনমত তৈরি হচ্ছে, জনগণের মধ্যে জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে। তাহলে তার উচিত ছিল সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু তিনি বলছেন না। বলছেন না কেন, সেটা ওনাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। এখন দেখুন, বিভিন্ন কমিশনে লোক বসাচ্ছেন তিনি। কিন্তু সবচেয়ে সিরিয়াস প্রবলেম তিনি অ্যাড্রেস করছেন না।

বাংলা ট্রিবিউন: এটাই বলছি, জনগণ এভাবে চাচ্ছে বলে আপনি বলছেন, সেই কথা তারা শুনতে পাচ্ছেন কিনা?

ফরহাদ মজহার: যদি শুনতে না পান, তাহলে তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। এই না শোনার মূল্য তো তাকে কোনও না কোনোভাবে দিতে হবে। ততদিনে দেরি হয়ে যাবে। তিনি জনগণের প্রতিনিধি কিনা, সেটা আমি বলতে পারবো না। সেটা জনগণই বুঝবে— তাকে নির্বাচন করাটা ঠিক হয়েছে কিনা। যে বিবেচনায় তাকে ছাত্ররা চেয়েছে, তার মধ্যে আমি দোষ দেখি না। তারা যা বুঝেছে তাই। কিন্তু সমস্যা দেখি, যখন তিনি ছেলেদের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, কিন্তু জনগণকে ভুলে যাচ্ছেন। এটা মারাত্মক। এটা জাতীয় রাজনীতির জন্য খুবই খারাপ। ছাত্রদের কাজ ছাত্ররা করেছে, সমাজে চিন্তা তৈরি হয়েছে, ভালো। ছাত্ররা অত্যন্ত  প্রতিভাবান কাজ করেছে। কিন্তু ড. ইউনূস এমনভাবে ছাত্রদের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, যেন তারাই তাঁকে ক্ষমতায় এনেছে। ফলে জনগণকে ভুলে গিয়েছেন, তিনি ভুল করছেন।

আমি জনগণের পক্ষে কথা বলি, জনগণের কথা শোনা আমার দায়িত্ব। তাদের কথা শোনার চেষ্টা করি, বোঝার চেষ্টা করি। তিনি জনগণের সঙ্গে কথা বলবেন কিনা, তার ব্যাপার। কিন্তু তিনি যখন ওপর থেকে এতগুলো কমিশন চাপিয়ে দিলেন, তখন জনগণের কথা যারা বলে, তাদের সঙ্গে তার কথা বলার দরকার ছিল।

এগুলো বাহ্যিক দিক। এগুলো দিয়ে তাকে বিচার করবো না, আপনারা বিচার করবেন। আমি মনে করি, আমার বক্তব্য দেওয়াটা দায়িত্ব। এটাই জনগণ আমার কাছে প্রত্যাশা করে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি বলছিলেন, এখন দুটো পদ্ধতি আছে, একটা গণপরিষদের. . .

ফরহাদ মজহার: গণপরিষদ আসবে পরে। অনেক কাজ আছে তার আগে। প্রত্যেকটা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে জনগণের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জনগণকে কথা বলতে দিতে হবে। তাদের অভিপ্রায় কী শুনতে হবে। সেগুলো হবে স্থানীয় গঠনতান্ত্রিক কাউন্সিল। তারপর ন্যাশনাল কাউন্সিল বানাতে হবে। লোকাল কাউন্সিল থেকে ন্যাশনাল কাউন্সিলে জনগণের অভিপ্রায় আনবেন। গণমাধ্যমেরও দায়িত্ব আছে। তারা তাদের জায়গা থেকে পরামর্শ দিতে পারে। যেমন- গণমাধ্যমগুলো সেমিনার বা প্যানেল আলোচনা করতে পারে। জনগণ কী চায়, বিভিন্ন স্তরের জনগণ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবেন,  তর্কবিতর্ক করবেন। তাদের পরামর্শ ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলে পাঠাবেন। কাউন্সিল জনগণের গঠনতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনা থেকে একটা খসড়া গঠনতন্ত্র খাড়া করবেন। জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল একটা খসড়া গঠনতন্ত্র জমা দেবে গণপরিষদকে। গণপরিষদ আলাপ- আলোচনা করে একটা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। পরে গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করার জন্য একটা রেফারেন্ডাম দেওয়া হবে, সেখানে গঠনতন্ত্র পাস হবে। প্রথম নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন। নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে সরকার নির্বাচন হবে পরে। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের মধ্যে জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আছে। অতএব,  জনগণের সঙ্গে ব্যাপক পরামর্শের ভিত্তিতে, সংলাপের ভিত্তিতে, গঠনতান্ত্রিক কাউন্সিল করে জনগণকে সম্পৃক্ত করা ও জনগণের পরামর্শ অনুযায়ী সকলে মিলে গঠনতন্ত্র তৈরি করাই হবে আদর্শ পথ।

এতে কী সুবিধা হবে? প্রথমত, জনগণ যখন দেখবে, তারা নতুন রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র আসলেই নিজেরা প্রণয়ন করছে, সমাজে স্ট্যাবিলিটি চলে আসবে। জনগণ যখনই সক্রিয়ভাবে গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে, তখনই এই যে তারা দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হচ্ছে, সেটা বন্ধ হবে।

৫০ বছরের কাজ যেটা আমরা পারিনি করতে, সেটা একবছরের মধ্যে করা যেতো। ম্যাজিক ছিল জনগণকে গঠনতন্ত্র প্রণয়নে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করাতে পারার মধ্যে। পার্টিগুলোর সহায়তা চাইতে পারতেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থার মধ্যে নিয়ে আসলে, স্বভাবতই জনগণ সম্পৃক্ত বোধ করবে। এর মানেই সরকারের স্থায়িত্ব বাড়া। লোকে অস্থির হয়ে যাবে না।

এই পুরো সময়টাতে জুলাই-আগস্ট, মানুষ ভাবছিল নতুন কিছু হবে। সরকার গঠনের কয়েকদিনের মধ্যে নিয়োগ-পদায়ন, অপরিকল্পিত মামলা দেখে বলতে শুরু করলো ‘যে লাউ সে কদু’। তাহলে আগের জায়গায় ঢুকে পড়ছে কিনা, আগের জায়গাতেই ফেরত যাচ্ছে কিনা।

জেফরি স্যাকস তৃতীয় বিশ্বের জনগণ নিয়ে, উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারভেনশনের তিনি ঘোরবিরোধী। তিনি পরিষ্কার বলছেন— বাংলাদেশে যেটা ঘটেছে সেটা ‘আমেরিকান রেজিম চেঞ্জ’। তাঁর এই মূল্যায়ন বিপজ্জনক আমাদের জন্য। জনগণ যেখানে যুক্ত সেটাতো কেবল ‘রেজিম’ চেঞ্জের ব্যাপার না। যদি হয়ও তার একটা পাল্টা প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে, প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে উঠলে, আপনি কী করবেন? আপনিতো বিপদে পড়ে যাবেন।

তাই বলে, বাংলাদেশ হাসিনাযুগে ফিরে যাবে, আমি সে সম্ভাবনা দেখি না। বরং কিছু কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। আমি মনে করি না, সবকিছু বৃথা যাবে। কিন্তু যেটা উপদেষ্টা-সরকার করছে, তাতে করে আমরা যতটা প্রত্যাশা করেছি— ততটা হয়তো পাবো না, সেটা হতেই পারে। এতে আমার কোনও অসুবিধা নেই, ব্যক্তিগতভাবে। কারণ,  আমি অতি উচ্চাশা প্রত্যাশা করি না। কিন্তু ইতিবাচক ভবিষ্যৎ দেখি।

আমি মনে করি, এই সংকটটা শুধু এই সরকারের তা না, সমাজের চিন্তার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের সংকট। ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনে বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটা ভালো লোকও খুঁজে পাওয়া কঠিন। সরকারকে পুরোপুরি দোষ দিতেও পারবেন না।