সংস্কৃতি রাজনীতির দাস হয়ে গেছে: মামুনুর রশীদ

বিশিষ্ট নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেছেন, সংস্কৃতি রাজনীতিকে পথ দেখাবে। তারপর সংস্কৃতি ও রাজনীতি পাশাপাশি চলবে। আর এখন সংস্কৃতি রাজনীতির দাস হয়ে গেছে। এই কথাটি বহুবার আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। একেবারে যারা মূল ধারার রাজনীতি করেন তাদের বলেছি। বামধারার রাজনীতিকদের মধ্যে এই চেতনা কিছুটা আছে। কিন্তু মূল ধারার রাজনীতিকদের মধ্যে এই চেতনা নাই।

শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আপনারা বোধহয় দেখেছেন যে একটি বক্তব্য রেখে মহাবিতর্কের মধ্যে পড়েছিলাম। এই রুচির দুর্ভিক্ষ কোত্থেকে? সেটা অশিক্ষা থেকে, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অভাব থেকে এবং সংস্কৃতির ওপর রাজনীতিকরা কোনও কাজ করেন না। কাজ করার প্রয়োজন বোধ করেন না। দিনের পর দিন তারা বক্তৃতা দেন। সময় নেই, একটা নাটক দেখেন না, ভালো করে একটি উপন্যাস পড়েন না, একটি কবিতা পড়েন না। তাহলে কী করে হবে? সংস্কৃতি রাজনীতির দাস যেদিন থেকে হয়েছে, সেদিন থেকেই সর্বনাশ হয়ে গেছে, এটি প্রণব মুখার্জির কথা। এই কথাটি বহুবার আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। একেবারে যারা মূল ধারার রাজনীতি যারা করেন, তাদের বলেছি, বামপন্থি রাজনীতিকদের বলেছি। বামধারার রাজনীতিকদের মধ্যে এই চেতনা কিছুটা আছে। কিন্তু মূল ধারার রাজনীতিকদের মধ্যে এই চেতনা নাই।’

বক্তব্যের শুরুতে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘প্রথমের আমি একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ আকর্ষণ করতে চাই। একটা পোস্টার আপনারা দেখেছেন বহুবছর ধরে। স্বাধীনতার পর  পর থেকেই। পোস্টারে লেখা আছে—বাংলার মুসলমান, বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিষ্টান আমরা সবাই বাঙালি। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে গান আছে, গানটি খুব জনপ্রিয় সব জায়গায় গাওয়া হয়। এরইমধ্যে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার যে উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা—এ দেশের অন্য জাতিসত্তাকে অস্বীকার করা এতেই প্রমাণ হয়ে আসে। যখন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়, আমি বহুবার দাঁড়িয়ে আপত্তি জানিয়েছি—এটি ভুল একটি বিবৃতি, এই গানটি গাওয়া হবে না। গত ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের পর থেকে আমরা বলেছি—সবাই মিলে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই গানটি আর গাওয়া হবে না, আর পোস্টারটি কেউ লাগাবেন না। আমি জানি না পরবর্তীকালে বাঙালিরা সেটা মানবেন কিনা।’

মামুনুর রশীদ আরও বলেন, ‘সংস্কৃতি একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী কাগমারিতে একটি সম্মেলন করেছিলেন। সেই সম্মেলনের সময় টাঙ্গাইল শহর থেকে কাগমারি পর্যন্ত অনেক তোরণ নির্মিত হয়েছিল। সেই তোরণগুলোতে শেলি তোরণ, বায়রন তোরণ, শেক্সপিয়র তোরণ, তার মধ্যে লেলিন তোরণ, মাওলানা রুমি তোরণ ছিল। অধিকাংশ তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল শিল্পী, লেখক, কবি, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় কবিদের নিয়ে। সেই সম্মেলনে একদিকে রাজনৈতিক বক্তারা বক্তব্য দিচ্ছেন, আরেক দিকে দিনভর গান হচ্ছে। মিসর থেকে একজন ড্যান্সারও এসেছিলেন। কলকাতা থেকে তারা শংকর, মনোজ বসু এসেছিলেন। একটি বই সৈয়দ আবুল মকসুদ কাগমারি সম্মেলনের ওপর লিখেছিলেন। বইটি পড়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, সংস্কৃতি রাজনীতিকে পথ দেখাবে। তারপর সংস্কৃতি ও রাজনীতি পাশাপাশি চলবে। আর এখন সংস্কৃতি রাজনীতির দাস হয়ে গেছে। রাজনীতির দাস যেদিন থেকে হয়েছে, সেদিন থেকেই সর্বনাশ হয়ে গেছে, এটি প্রণব মুখার্জির কথা।’

মামুনুর রশীদ বলেন, আমাদের রাজনৈতিক কর্মীরা কী জানেন—আমাদের দেশের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় অনেক বড় বড় কবি আছেন? আগরতলাতে একজনকে পুরস্কৃত করলাম। সাঁওতালদের মধ্যে অসাধারণ সব কবি আছে। আমরা জানি না, তাদের লেখাও পড়ি না, জানার প্রয়োজনও বোধ করি না, তাহলে কী করে হবে? কেউ কেউ যে পড়েন না, তা বলছি না। কিন্তু মূলধারা একেবারেই এই সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে আসছে। সাঁওতালদের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে।’