কাগজের দাম দ্বিগুণ, প্রভাব পড়বে বই মেলায়ও

দেশে এক বছরের মধ্যে ৮০ ও ১০০ গ্রামের অফসেট ও সাদা কাগজের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আর নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। এই পরিস্থিতির কারণে বেড়েছে শিক্ষা ব্যয়। আগামী জানুয়ারি থেকে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ব্যয় আরও বাড়বে। অন্যদিকে আগামী বইমেলায় সংকটে পড়বেন সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশকরা। আশঙ্কা রয়েছে, বেশি দামে বই কিনতে আগ্রহ হারাবেন পাঠকরা। 

সৃজনশীল প্রকাশনীগুলো জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দামের চেয়ে বাংলাদেশে কাগজের দাম বেশি। এক বছরের কাগজের দাম প্রায় দিগুণ হয়েছে। দেশে কাগজ নিয়ে যে অস্থিরতা চলছে তাতে দাম কমাতে হলে কাগজ আমদানি আপাতত শুল্কমুক্ত করতে হবে। ৪০ থেকে ৪৯ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করে কম দামে কাগজ দেওয়া সম্ভব না। এছাড়া যত কাগজ এই মুহূর্তে দরকার, দেশি কাগজকলগুলো তা সরবরাহ করার সক্ষমতা রাখে না।

অফসেট কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণ

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির তথ্যমতে, গত বছরের চেয়ে এবার দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিয়ে কাগজ কিনতে হবে প্রকাশকদের। ৮০ গ্রামের এক রিম অফসেট কাগজের গত বছর দাম ছিল এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৫৫০ টাকা। সেই কাগজ প্রতি রিম কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়।

প্রকাশকরা জানান, এক বছর আগে ১০০ গ্রামের কাগজ প্রতি রিমের দাম ছিল এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা। এবার একই কাগজ প্রতি রিম কিনতে হচ্ছে চার হাজার ৪০০ থেকে চার হাজার ৫০০ টাকায়। কাগজের দাম দ্বিগুণেলও বেশি বাড়ায় বইয়ের দাম বেড়ে যাবে। ফলে পাঠক যেমন প্রয়োজনীয় বই কিনতে পারবেন না, তেমনি প্রকাশকরাও বই ছেপে লোকসান গুনবেন।

নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়েছে তিনগুণ

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর এক মেট্রিক টন নিউজ প্রিন্ট কাগজের ছিল ৪০ হাজার টাকা। সেই কাগজ এবার এক টন কিনতে হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। প্রায় তিনগুন দামে এবার নিউজপ্রিন্ট কাগজ কিনতে হবে। নিউজপ্রিন্ট এক রিম কাগজের দাম গত বছর ছিল ৪২৫ টাকা। এবার কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৮০ টাকায়।

প্রভাব পড়বে বইমেলায়

২০২১ সালে একুশের বইমেলায় নতুন বই বের হয়েছিলো প্রায় সাড়ে চার হাজার। এ বছর করোনার প্রভাব না থাকায় এ সংখ্যা আরও বাড়বে। সৃজনশীল বই প্রকাশক জানান, বইমেলার জন্য নতুন বইয়ের প্রায় দশগুণ পুরাতন বই ছাপা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার বই ছাপার প্রয়োজন হবে। কাগজের মূল্যবৃদ্ধি এবং কাগজ সংকটের কারণে নতুন লেখকদের একাংশ এবার বই ছাপার সুযোগ পাবেন না। 

এই মুহূর্তে দেশি কাগজকলগুলো প্রয়োজনীয় কাগজ সরবরাহ করতে পারছে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্য বইয়ের জন্য এনসিটিবি কাগজ কিনেছে প্রায় এক লাখ টনেরও বেশি। আগামী জানুয়ারি থেকে প্লে-গ্রুপ, নার্সারির শিক্ষার্থী থেকে মাস্টার্স পড়া শিক্ষার্থীর জন্য যে কাগজ প্রয়োজন তা সরবরাহ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া রয়েছে অনুশীলন বই বা নোটগাইড।  সব মিলিয়ে কাগজ সংকট তীব্র হবে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা দেশি কাগজ কলগুলোর নেই।

আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশে কাগজের দাম বেশি

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে কাগজের দামের তুলনায় বাংলাদেশে কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণ। ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়ায় ফিনিশড একটন কাগজের (৯৫ শতাংশ ব্রাইটনেস) দাম ৮০০ ডলার বা ৮১ হাজার ৬০০ টাকা (কমবেশি হতে পারে)। চীনে একটন কাগজের দাম ৭০০ ডলার বা ৭১ হাজার ৪০০ টাকা। এই মানের চেয়ে কম কম মানের (৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেস) একটন কাগজের বাংলাদেশে দাম এক লাখ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।   

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির দাবি

পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুবিধা দেওয়াসহ পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করে। সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন লিখিত দাবি তুলে ধরেন।

দাবিগুলো হলো— অস্বাভাবিক কাগজের দাম বৃদ্ধির কারণ তদন্ত করে ব্যবস্থা করা, দ্রুততম সময়ে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানিতে শুল্কমুক্ত ঘোষণা, দেশের সব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কাগজকে রিসাইকেলিং কাজে ব্যবহার করার ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক রাখা, কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর গুদামজাত করা কাগজ স্বাভাবিক মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা এবং শুল্কমুক্ত করা ছাড়াও অন্য ভর্তুকি বা প্রণোদনামূলক ছাড় দেওয়া।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশকরা জানান, পরিস্থিতি না বদলালে ২০২৩ সালের একুশে বই মেলাসহ শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থবিরতা তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরা লেখার কাগজ পাবে না। এমনকি ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ও কাগজের ব্যাগ তৈরির কাজও থমকে যাবে।

দেশের বাজারে মুদ্রণ এবং লেখার কাগজের সংকট তৈরি হয়েছে। একটি সিন্ডিকেট চক্র এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কাগজের যে আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, অতীতের যেকোনও সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। এটি ভয়াভয় আকার ধারণ করেছে। আগামী বছরের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় বিঘ্ন তৈরি হবে, তেমনি অমর একুশে বই মেলায় বইয়ের দাম বেড়ে যাবে। প্রকাশকরা নতুন বই প্রকাশ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল বলেন, ‘বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির কাঁচামাল পাল্পের যে পরিমাণে দাম বেড়েছে, তার চাইতে দুই থেকে আড়াই গুণ দাম মিল ও কাগজ ব্যবসায়ীরা আদায় করছে। তাদের মধ্যে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। স্বল্প পরিমাণে পাল্প আমদানি করে কাগজের সংকট তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করছে।  অন্যদিকে কাগজ সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই তৈরি সংকটে পড়েছে। আগামী বই মেলায় নতুন বই প্রকাশনা কমে যাবে, মূল্য বাড়বে। শিক্ষার্থীদের সহায়ক বই, লেখার খাতাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য কাগজ পাওয়া যাবে না। ‘

দ্রুত সময়ের মধ্যে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির ঘোষণা চেয়ে শ্যামল পাল বলেন, ‘এখনও সময় আছে। আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে এলসি করে কাগজ আনতে ১৫ দিনের সময় লাগবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘোষণা দেওয়া হলে পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে কাগজের দাম কমে যাবে।’

বাতিঘর প্রকাশনীর দীপঙ্কর দাস বলেন, ‘পাল্প আমদানি করা যাচ্ছে না। কাগজের দাম বেশি। সে কারণে বইমেলায় তো প্রভাব পড়বেই। যারা কিনতে চাইবে তাদের তো বেশি দামে কিনতে হবে। সব কিছুরই দাম বেড়েছে, এখানেও বাড়বে।’

বাংলাদেশ পেপার ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও এফবিসিসিআই পরিচালক শাফিকুল ইসলাম ভরসা বলেন, ‘এখন যে সংকট সেটা ব্যাংক থেকে এলসি না পাওয়ার কারণে। যাদের ডিউটি ফ্রি অনুমোদন আছে তারাও খুব বেশি এলসি করতে পারছে না। করোনার পর থেকে দেশের একটি বিশেষ গোষ্ঠী নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতো কাগজ নিয়েও সিন্ডিকেটের খেলা চালাচ্ছে। যেভাবে চলছে তাতে শতভাগ মার্জিন দিলেও এলসি দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো।’

আম্বার পেপার মিলস লিমিটেডের পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে মোট ২০৬টি পেপার মিল। এরমধ্যে চলমান ৭০ থেকে ৭৫টি। এদের মধ্যে প্যাকিংয়ের জন্য বা গ্রাফ পেপার ইত্যাদি তৈরি করে কিছু পেপার মিল। যদি লেখা ও ছাপার কাগজের মিল বলি, তাহলে ৩০ থেকে ৩৫টা রয়েছে। তারা মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার মেট্রিক টন কাগজ বানায়।’

আরও পড়ুন-

কাগজ নিয়ে উদ্বেগ

কাগজের মানে ছাড়, তবুও পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে অনিশ্চয়তা