রমণীয় রাত

ন্যাকড়াটা রক্তে ভিজে জবজবে। চাপ লাগলেই মনে হয় ট্যাবায়ে পড়বে! এই সংশয়ে উঠে দাঁড়ায় না ময়না। হাঁটু মুড়ে দুই হাঁটু দুই দিকে এলিয়ে এমন কায়দায় বসে আছে যাতে চাপ না লাগে ন্যাকড়ার ওপর। ন্যাকড়াটা এখন বদলানো খুব দরকার। জ্বর জ্বর ভাব ধরা শরীরে ভেজা ন্যাকড়ার অস্বস্তি একেবারে খিঁচিয়ে দিয়েছে মেজাজটাকে। সেই সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি ঝরছে মুষলধারায়। বৃষ্টির দিকে যতবার নজর পড়ে ততবারই ময়নার চেহারায় আরও বাড়ে রাগ-ক্ষোভ-হতাশা। দাঁত খিঁচিয়ে একা একাই বলে—মরার বৃষ্টি, যা ভাসাইয়া লইয়া যা দুনিয়াডারে। সে ভাবে হয় ওপর দিয়ে, না হয় ভেতরে আরেকখান ন্যাকড়া গুঁজে রাতটুকু ঠ্যাকা দিতে পারলেই হইল। এই বৃষ্টির মধ্যে ন্যাকড়া বদলাতে হলে তাকে উঠে যেতে হবে ডাস্টবিনের ময়লার স্তূপের ওপাশের অন্ধকারে। তখন একেবারে গোসল হয়ে যাবে সারা শরীর ভিজে। শুকনার রাত হলে ময়না হয়তো রাতে আরেকবার বদলে আসত ন্যাকড়াখানা। কিন্তু আজ আর ইচ্ছা হয় না সর্দিকাশি জ্বরের কাঁপ লাগা শরীরটাকে ভেজাতে।

বেশ কয়েকবার ছেলেকে ডাক দেয় ময়না। অন্যদিন হলে হয়তো ঝটপট উঠে কোলের কাছে ধরে আনত ছেলেকে। ময়না যতবারই ধরে এনে কাঁথার তলে ঢোকানোর চেষ্টা করে ততবারই ছেলে তার বের হয়ে যায়। এ্যারে পোলা, কথা হুন কইলাম! নইলে হাড্ডি মাংস কিন্তু এক কইরা দিমুনে। আইজ কইলাম তর একদিন কি আমার একদিন। ময়না এই কথা বলার সঙ্গেই ময়নার নানি পানে প্যাঁচানো কাঁচা সুপারির ওপর নড়বড়ে দাঁত দিয়ে ছেঁচা দিয়ে বলে—ক্যারে, হাড্ডি গুড়া করতি ক্যারে? পোলানি হুদা তর একলারনি? সারা দিন পোলা টানি আমি। রাখোছ তো খালি কোলের লগে রাইতটুকু ঘুমানির সোময়। হেইডাও আবার গুড়াগুড়া করবার চাস! এ্যামুন ইতরের ইতর নডিডা তো আমি আর দেহি নাইকা বাপের জন্মে! ছাড়, ছাড়োন দে, হ্যারে আর তর দুধ দেওন লাগব না! দুধের পোলা, এইডার আবার হাড্ডি গুড়া করনের কী আছে বুজলাম না তো!

পোলা কি আমার না তর? অই বুড়ি? আমার পোলা আমি যা খুসি মনে লই হেইডা করুম তর কী?

হ, পোলা তো তর, কিন্তু পালতাছে ক্যাডা? এই পোলা দিয়া কত ট্যাকা কামাই করোছ হুস আছেনি কোনো?

এত্ত হুসের কাম নাই, এইডার লাইগাই তো পইরা থাকতে হয় ফুটপথে! তা নাইলে তো বাসাবাড়ির বান্দা কামকাইজ করতে পারতাম। পারতাম রাইতরে আরাম কইরা ঘুমাইতে। হ্যার লাইগাই তো মাইনষে লয় না বাসাবাড়িতে বান্দা কামে। আমার জানে আর কুলায় না মশল্লা পিষনের, পিয়াজ কুডনের কাম! এত্ত খারাপ লাগতাছে আইজকা শরীলডা কী কমু তরে! এত্ত বিষাইতাছে সারা শরীল! আমি কোতদূর ঘুমানির লাইগা ছুডি নিলাম মালিকের থেইকা। আর অখন চোকখের পাতা এক করতে পারতাছি না পোলার লাইগগা? বাপের মতো বেজন্মার বেজন্মা হইছে, তুই দ্যাহোস না?

তো, গাইল তো পারবি বেজন্মাডারে! হ্যার লগে এ্যারে আবার গালি দ্যাছ ক্যারে? হ্যার বাপের খ্যাদ পোলার উপরে তুলোছ ক্যারে? এত্ত যদি হ্যাডোম, যা হ্যার বাপের লগে দ্যাহা গিয়া খাইচ্চোরনি।

হ, যা কইছস! কিরা কছম খাইলাম, একবার যদি পাই বেজন্মার বেজন্মাটারে! কইলজা টাইনা ছিড়ুম আমি হ্যার! স্বামী পরিত্যক্ত ময়না। ছেলের ওপর দিয়ে মেটায় এভাবেই স্বামীর ওপরের রাগ-খেদ। তার স্বামী তাকে ফেলে চলে গেল যখন সবে মাত্র সে পোয়াতি। যাওয়ার আগে বলে গেল সে আর সংসার করবে না ময়নার সঙ্গে। কারণ তারে একখান দোকান দেওনের পুঁনজি পাটটি দেয়ার ক্ষেমতা নাই ময়নার মায়ের। গাঁও গ্যারামের পোয়াতি ময়না সন্তান বিয়ানির জন্য পড়ে থাকে গ্রামে। তারপর আঁতুড়ঘরের গন্ধ জড়ানো ছেলে কোলে নিয়ে চলে আসে ঢাকা শহর। গ্রাম সম্পর্কের এই নানীর সঙ্গে আশ্রয় নেয় গ্রিনরোডের ফুটপাতে। প্রথম কিছুদিন চেষ্টা করে বাসাবাড়ির বান্ধা কাজের। এমন গ্যাদা বাচ্চা নিয়ে কেউ বান্ধা কাজে না রাখলে ময়না শেষ পর্যন্ত শুরু করে রেস্টুরেন্টের ছুটা কাজ। সেই থেকে নানির লগে ময়না গ্যাদা ছেলে নিয়ে ঘুমায় এই ফুটপাতেই।

ময়নার ছেলে কোলে নিয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকে ময়নার নানি। দুধের শিশু কোলে দেখলে বড় লোকদের মহব্বত হয় অনেক বেশি। ময়নার উলঙ্গ ছেলে কোমরের কাছে ঝুলিয়ে দুলিয়ে গাড়ির জানালার কাছে গিয়ে হাত পাতলেই হাতে এসে পড়ে ছোটবড় টাকার নোট। এই ছেলের জন্য ময়নার নানির এখন ভালো রোজগার। হাত বাড়িয়ে ময়নার ছেলেকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে নানি শাসায় ময়নাকে—

হঅ, হঅ, বুজছি, তর যা মনে লয় হ্যারে কর গিয়া। ল্যাদা পোলা এইডারে ছাইরে কথা কঅ, যা তুই ঘুমা। আমি দ্যাখতাছি হ্যারে। হ্যার যখন মন লয় হ্যায় ঘুমাইবোনে। এই সব বলে আহ্লাদে গদগদও কণ্ঠে বুড়ি ময়নার পোলাকে সোহাগ করে, ও জাদু , ওরে সোনা, আহো…আহো…, আমার কোলে আসো…সকালে লজেন কিনা দিমুনে, পাউরুটি কিনা দিমুনে আবুত্তার দোকান থিকা। আররর…বেলুন কিনা দিমু আহো… 

এভাবে সোহাগ ভরে ডাকতে থাকে বুড়ি নাতিকে। সেদিকে তাকিয়ে ময়নার চেহারায় ফুটে ওঠে চাপা হাসি—মনে মনে বলে—হায়রে টাকা। পোলাডারে দিয়া টাকা কামাই হয় বইলা কত্ত দরদ দেখায় বুড়ি আমার পোলারে!   

খকর খকর কফ নামায় শামছু হাঁপাতে হাঁপাতে। একই সঙ্গে আবার হাসেও কফ নামানোর মতোই। কতটুকু হাসি আর কতটুকু কফ নামানি বোঝা কঠিন।  হাসি অথবা খাঁকানি টেনে ধরে নানির কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে—তা যা এ্যাক্কেরে হ্যাচা কথা কইছত ময়নার নানি। হ্যায় তো আর কারও লগে পাইরা উঠে না, খালি পারে এই দুধের পোলাডার লগেই! এত্ত যখন ক্ষেমতা যা নারে, হেই ব্যাডার লগে দ্যাহা গিয়া! ব্যাডায় তো ফেইলা গ্যালো, কী বালডা ছিড়বার পারছোস? কয়ডা ট্যাকার লাই তো তরে ছাড়ি গ্যাছে, আবার কছ বিয়াও বইছে! ফাইরলে যাই ভাঙ গিয়া ব্যাডার হ্যাডোম! শামছুর কথা ময়নার কানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে হেসে বলে ওঠে—নানির লগে পিরিতি বাড়ছে মনে হয়? শামছুকে অনুকরণ করে গলা খাঁকিয়ে এ্যাহেহে…এ্যাহেহে…করে হেসে ওঠে ময়না। সেই হাসির সঙ্গেই আবার বলে—অই মরার মরা, বুড়িরে ত্যাল দ্যাছ ক্যান? খিকখিক করে হাসতে হাসতে বাঁ হাতে ঠেলে দেয় ছেলেকে নানির কাছে। আর ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা জোড়া করে শামছু মিয়ার হাত থেকে টেনে নেয় আধপোড়া সিগারেট।

নানা রকমের মানুষ আর যানবাহনের ক্রমাগত আনাগোনার ভেতর দিয়ে গড়াতে থাকে রাত। ঝাপবন্ধ দোকানের সামনে বসে থাকে ওরা সবাই একসঙ্গে। এইখানে দোকানের সামনে প্লাস্টিক বিছানো টানা ছাউনি। দোকানের সামনে বের করে দেয়া মালপত্র রোদবৃষ্টি থেকে সামলানোর জন্য। এখানে ঘুমালে ভয় থাকে না বৃষ্টিতে ভেজার। কখনো রিকশার টুংটাং, কখনো হালকা যানবাহনের পমপামপম, কখনো বাস ট্রাকের কান ফাটানো ভারী হর্ণ—সবকিছু এক হয়ে ঢুকে পড়তে থাকে ওদের অপেক্ষমাণ দেহের ভেতর। হয়তো রাস্তার এপার ওপার করে দু-একটা সাহসী কুকুর। তাদের কোনোটা মোটাগোটা, কোনোটা শুকনা খটখটে। তাদের কোনোটা কখনো রিকশার চাকা অথবা মানুষের পায়ের সঙ্গে গুঁতাগুঁতি খেয়ে করে ওঠে কুউউউ কুউউউ…কাউউউ কাউউউ। ভবঘুরে কুকুরেরাও ফুটপাতবাসী মানুষদের মতো অপেক্ষা করতে থাকে নিদ্রার অনকূল নীরবতার জন্য। একেবারে ডান ধারে ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি আবুর দোকান। তারপর আছে মতি মিয়ার রড সিমেন্টর দোকান, রড সিমেন্টের দোকানের পরেরটা বাথরুম ফিটিংসের। দোকানগুলোর সামনে আর আশপাশেই ঘুরঘুর করে ওরা।

শামছুর পাশে ঝুড়ির ভেতরে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে তোফা। তোফা বিছানা ছাড়ে সেই আজানের সময়। টুকরি নিয়ে দৌড়ায় কাওরানবাজারে। এক ঝুড়ি মাছ নিয়ে ফেরি করে এই এলাকায়। যেদিন যেরকম মাছের ভালো দর পায় সেদিন সেই মাছ নিয়ে আসে পাইকারি দামে। সারা দিন যে ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে ফেরি করে, রাতে সেই ঝুড়ির ভেতরেই একখানা ছালার বস্তার ওপর ঘুমিয়ে পড়ে  কুকুর বিড়ালের মতো দলা পাকিয়ে। বিছানা করার আলসেমিতে সে এভাবেই ঝুড়ির ভেতর গুটিশুটি মেরে শোয়। বহুদিন ময়না ডাক দিয়েছে, অই ছ্যামড়া, কুত্তা, বিলাইয়ের লাহান ঘুমাস ক্যামনে? এ্যামনেনি আশ মিটেনি শইললের? যা, ছ্যামড়া, নাইমা ঘুমা, হাত-পাও মেইলা ঘুমা, তাইলে না শরীলের তস মিটবো, শরীলডা বাড়বো, আর নাইলে এ্যাক্কেবারে খাডুয়া হইয়া যাবি আমি কইলাম! 

তোফা জেগে থাকলে এক কাপ চা আনাতে পারত। রোজ সন্ধ্যায় সে যেন অপেক্ষায় থাকে কখন ময়না ফিরবে কাজ থেকে। ময়নার জন্য পানি, পান, চা এই সব ফুটফরমাশ করে তোফা আনন্দের সঙ্গে। তোফাকে ঘুমাতে দেখে আজ ময়না বিরক্ত হয় খুব। ছ্যামড়া ভাদাইম্মা, সোনদার লগে লগেই ক্যামনে ঘুমায়! এখানে ফুটপাতের মালিক সরকার, কিন্তু দোকানগুলা হলো মালিকদের। এই পাশটায় পাঁচখানা দোকানের সারি। প্রথম যখন ঢাকা আসে দোকানের উলটো দিকে কিছুদিন বিছানা পেতেছিল ময়না। এই সারির একেবারে সামনে খাড়া বিদ্যুতের খুঁটি। ঐ খুঁটির জোরে বিদ্যুতের আলোর বেশ দাপট। ময়না যে সারিতে এখন বিছানা পাতে তার শেষ মাথায় খোলা জায়গায় মিউনিসিপ্যালটির ময়লা ফেলার বিশাল স্তূপ। ট্রাকের মতো দেখতে ভারী লোহার একখান বিরাটকায় ফ্রেম স্থাপন করা হয়েছে শেষ দোকানটার এপাশে। গ্রিনরোড, স্টাফ কোয়ার্টার, কাঁঠালবাগানের সমস্ত ময়লা আবর্জনা এনে এখানে জমায় মিউনিসিপ্যালটির ছোট গাড়ির ময়লাওয়ালারা। তারপর এখান থেকে দিন শেষে তুলে নিয়ে যায় মিউনিসিপ্যালটির বড় ট্রাক। কাঁঠালবাগানের ঢাল, লেকের পাড়ের, গ্রিনরোড, ধানমন্ডির আশপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙারি টোকানো পোলাপান এইখানে ময়লা ঘাটে সারা দিন।  বস্তায় ভরে পছন্দমতো টুটাফাটা, ভাঙাচুরা।

ওপাশের ফুটপাত ছেড়ে ময়না যখন এপাশটা বেছে নিল তখন ওর নানি জিজ্ঞাসা করেছিল—তর মাথার ঠিক আছেনিরে ময়না? ময়লার গাড়ির ধারে বিছানা পাতোছ? ময়না হেসে উত্তর দিল—খালা, ময়লার এই গাড়িটার লাইগগা এই ধারে আলো কম। রাইতরে কী সুন্দর আন্ধার ভাও দেয়। আর আন্ধারের লাইগা মাইনষের হাটোনও কম। লাফাইয়া লাফাইয়া মাইনষে গায়ে গতরের উপর দিয়া ডিঙ্গাইবো না। শান্তিতে ঘুমানির লাইগা এই পাশটাই ভালা। নিজের জন্য এই পাশটা নির্ধারণ করে সে নানিকে বলে—তুই মাইজখানে ঘুমা, গন্দো লাগবো না। আর ঘুমাইলে কীয়ের গান্দাগুন্দা! এত্ত গান্দা লাগা ভালা না গরিবের নাকে। এইহানে শুইলে শো, নাইলে যেইহানে তর মন চায় তুই গিয়া ঘুমা। রঙ্গের কথা কইছ না আমার লগে। বুড়ির হাউস দ্যাখলে বাঁচি না, আমি এইহানেই হুমু।  বেডি…আস্তা ছাগল, ফুটপথের আবার এইধার আর হেইধার, আর বাঁচলাম না!  এই রকম রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করে ময়না ক্রমাগত নানির সঙ্গে। হয়তো এসব ঝাঁঝালো কথা শুনিয়ে কাঁথা মুড়ি দেয় ছেলেকে কোলের ভেতরে ঠেসে ধরে।

আজ ময়না নানির কাছে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে ঝিমায় হাঁটুর ভেতর মাথা গুঁজে। হাঁটুর ওপর মাথা গুঁজতে গেলে নিজের শরীরের ভেতর থেকে আসা রক্তের বোটকা গন্ধে নিজেই নাক সিটকায়। শরীরের ভেতরে স্যাঁতসেঁতে অনুভূতি।  বৃষ্টির ছাঁটে ঘুমানোর বস্তা, কাঁথা সবকিছুর স্যাঁতসেঁতে দশায় আজ অতিরিক্ত বিরক্ত ময়না সবকিছুর ওপর। বসে বসে ঝিমায় আর অপেক্ষায় থাকে ফারুইক্কার  দোকানের ঝাপ নামার। যেই মাত্র ফারুইক্কার দোকানের ঝাপ নামে অমনি সে চঞ্চল হাতে বস্তা বিছায়। বস্তার ওপর কাঁথা। তার কাঁথা হইল দুইটা। একটা বিছায়ে আর একটা গায়ে দিলে শীতে শরীরে ওঠে কাঁপ। একদিকে শীত, অন্যদিকে শরীরের ভেতর থেকে চুইয়ে বের হওয়া রক্তের কথা মনে পড়তেই উঠে বসে সে। মাসিকের রক্ত চুয়ানোর শঙ্কায় ময়না পিঠের নিচে কাঁথা পাতে না আজ আর।

পিঠের তলের কাঁথাটা তুলে নিজের শরীরের ওপর চাপা দেয় আর পিঠটা থাকে বস্তার ওপর। রাস্তায় পড়ে থাকতে হয় বলে ময়না নিজের হাতে যত্ন করে সেলাই করেছে তিনটে কাঁথা। গ্রাম থেকে আনা পুরনো ছেঁড়া কাঁথার ওপরে জোড়া লাগানো পুরনো শাড়ি। পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে সের দরে পুরনো শাড়ি কিনে মোটা সুতলির ধাগা সেলাই দিয়ে শক্ত করেছে নরম শাড়ির বুনট। চারপাশে জোড়া দিয়ে বাড়িয়েছে এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সবই। ছেলেসহ নিজেকে একেবারে মুড়ে ঘুমানোর মতো। আকারে বিস্তৃত এই ধোকলার দিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে নানি যখন অভিযোগ করেছে—ঐ হারামি নড্ডি, বেইমান বেডি, চোখ নাই বইলা আমারে দেখাইয়া খ্যাতা স্যালাছ। নানির এই কথায় সে উত্তর দিয়েছে—থাক আর গাইল পারোন লাগবো না। এই লঅ, বলে নানিকে দিয়ে দিল একখানা। একের পর এক পুরনো শাড়ি জোড়া দিয়ে কাঁথা দুটো এখন মোটা হয়েছে ধোকলার মতো। নানিকে কথা দিয়েছে শীতের আগে এবার সে আরও দুটো শাড়ি জোড়া দিয়ে মোটা করে দেবে নানির কাঁথা। মাঝে মাঝে তার নিজের ছেলেও যে নানির কাঁথার নিচে ঘুমায়!  

কোমরে, তলপেটে চিনচিনে ব্যথার সঙ্গে এবার টনটনে যন্ত্রণা শুরু হয় কপালে। মাথা, সারা শরীরের সমস্ত মাংসে শুধু নয়, মনে হয় হাড্ডিগুড্ডি সব কিছুতেই ব্যথা। রাস্তার উলটোধারে এখনও মতিনের পানের দোকান খোলা। সেখানে হাসি ও রোজিনা দাঁড়িয়ে। পান খায় আর আড্ডা দেয় মতিনের সঙ্গে। ওরাও ফুটপাতের বাসিন্দা। তবে নড্ডিগিরি করে সবাই কয়। রঙিন ফুলছাপা শাড়ি, ব্লাউজ, পায়ে স্যান্ডেল থাকে সবসময়। পান খায় আর খিলখিল হাসে কারণে অকারণে। খলবল করে পানের দোকানের চারধারের মানুষের সঙ্গে। ওদের দিকে তাকিয়ে ময়না গালি দেয় বিড়বিড়িয়ে—নড্ডিগুলা, সারা রাইত কম কামায় না! যেইহানেই ব্যাডা, হেইহানেই হ্যাগো পয়সা। ওরাও ঘুমায় মতিনের পানের দোকানের ওপাশে। ওরা হয়তো চেনে না ময়নাকে, কিন্তু ময়না ঠিকই চেনে ওদের। সে এখন চেনে ওর দুই পাশে ঘুমানো অনেক মানুষকেই।

মতি মিয়াও ঘুমায় ওদের পাশে। মতি মিয়ার সঙ্গে ভালো খাতির নানি আর শামছুর। ময়নার সঙ্গে কারও খুব একটা খাতির হয়নি এই দুই বছরেও। সারা দিন কামের শেষে এখানে এসে সে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে নানির পাশে। তখন তার আর ইচ্ছে হয় না কারও সঙ্গে কথা কইতে আজাইরা। ওর খাতির শুধু শামছু আর তোফার সঙ্গে।

নানির হাতে ছেলেকে ছেড়ে ময়না নিজেকে ঢাকে কাঁথার তলে। যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে। ইহচই চিল্লাবিল্লার ভেতরে কখন যেন ঘুমে তলিয়ে যায় ময়না। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নানি ছেলেকে নিয়ে, কখন হানা দিয়েছে রাতের নিস্তব্ধতা, কখন শেষ কোলাহলও থেমে গেছে ময়না কিছুই টের পায়নি আজ। মাঝরাতের নীরবতা ভাঙা দু-একটা যানবাহনের শব্দ, পথের ধারের কুকুরদের ঘেউ ঘেউ কুউউ ডাকও আঘাত হানতে পারেনি ময়নার ঘুমের ওপর। কখন বৃষ্টির ধারা মুষল হয়েছে, কখন বিরতি দিয়েছে সেসবও জানে না ময়নার ঘুমকাতর দেহ। শুধু ময়না না, এখন ফুটপাতবাসী সব মানুষগুলোর একই দশা হয়তো।    

ময়না এখন জানে না রাতের কোন প্রহর। ময়নার ঘুমের ভেতর অতর্কিত হামলে পড়ে দুমদাম, ধুপধাপ অস্থির অনেকগুলো পায়ের শব্দ। মাটিতে কান পেতে শোয়ার কারণে যেকোনো শব্দই কানের ভেতর ঢুকে পড়ে খুব দ্রুত। ময়নার ঘুম হালকা হলে সে সাবধানে উঁকি দেয় চোখের সামনে থেকে কাঁথা সামান্য সরিয়ে। একেবারে রাস্তার ওপর দিয়ে দৌড়ে গেল কয়েকটা মানুষ। ভয়ে কাঁপন ধরে  ময়নার শরীরে। এই সব দৌড়াদৌড়ি নতুন কোনো ঘটনা নয়। তারপরও ময়নার শরীরে ভর করে ডরভয়। ময়নার মনে হয় অস্থির পায়ের আওয়াজগুলো এগিয়ে এলো ওর দেহের পাশে। নিঃশ্বাস বুকের কাছে চেপে ধরে সে মাটিতে কান পেতে রাখে সাবধানে। অস্থির পায়ের আওয়াজ কাছে এগিয়ে এসে ময়নার পাশে থমকে দাঁড়ায়। ধপ করে ভারী শব্দের সঙ্গে একজন মানুষ দ্রুত ঢুকে পড়ে ময়নার কাঁথার ভেতরে। ময়না কিছু একটা বলতে যায়। অমনি শক্ত হাতের থাবা চেপে ধরে ওর মুখ। পরমুহূর্তে ময়নার কানের কাছে ঠোঁট চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে—

তর পায়ে পড়ি, তুই আমার মা, আমার বোইন, আমারে বাঁচা। চিল্লাইছ না, আমি তরে কিছু করুম না। খালি আমারে একটু লুকাইতে দে বোইন, আমারে একটু লুকাইয়া রাখ। শক্ত হাতের থাবায় চেপে ধরা ময়নার গলার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে কুউউ কুউউ…সামান্য গোঙানির শব্দ। ময়নার মুখের ওপরে থাবাটা আরও শক্ত হয় দ্রুত। আরও শক্ত করে জাপটে ধরে ময়নাকে এবার মানুষটা। আমি তোর পায়ে পড়ি বোইন, অরা ধরতে পারলে আমারে জানে মাইরা ফেলবো এ্যাক্কেবারে। ঢাক বোইন, ঢাক, আমারে ঢাইকা রাখ তর খ্যাতাডার  তলে। মানুষটার বুকের ভেতরে দিলকলিজা সব যেন লাফাতে থাকে হাঁপড়ের মতো। হাঁপানির চোটে ময়না শুনতে পায় দ্রিম দ্রিম ধাপ ধাপ হৃৎপিণ্ডের শব্দ। বাঁচার আকুতিতে হৃৎপিণ্ডটা যেন বুকের খাঁচা ছেড়ে পালাবে। থরথরিয়ে কাঁপে জোয়ান মরদের শক্ত শরীর। 

ময়না মাথা নাড়ে বালিশের ওপরেই আত্মসর্মপণের ভঙ্গিতে। ময়নার এই মাথা নাড়া হয়তো আশ্বস্ত করে মানুষটাকে। এবার কিছুটা শিথিল করে লোকটা তার হাতের থাবা। ভয় কাঁপন ধরা মানুষটা নিজেকে আড়াল করতে ময়নার বুকের ভেতর গুঁজে ধরতে চায় নিজেরে। খুব সাবধানে নিজের মুখ মানুষটার কানের কাছে এগিয়ে এনে ভীরু কণ্ঠে ময়না জিজ্ঞেসা করে—

কী করছেন? ডাকাতি না খুন?

এই সব কিচ্ছু করি নাই। আল্লার কসম বিশ্বাস কর। সব কমু, পরে কমু, খোদার কসম, সব কমু। আগে আমারে একটু বাঁচা। আইয়া পড়ল, ঢাইকা রাখ তুই আমারে। যদি খ্যাতা সরাইয়া কিছু জিগায় তুই কইস আমি তর স্বামী। বোইন না, আমারে খালি একটু জানে বাঁচা। মাইরা ফালাইবো বোইন, মাইরা ফালাইবো। এই বলে কাঁথার তলে জাপটে ধরে ময়নার দুই হাত। তর পায়ে পড়ি বোইন, আজীবন তর গোলামি করুম। এখন চুপ থাক কোতদূর।

একমুহূর্তে ময়না কী যেন ভাবে। তারপর কাঁথার তলে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে মানুষটাকে। হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে এলোমেলো করে দেয় মানুষটা মাথার চুল। ফিসফিসিয়ে বলে—কথা কইবেন না, চুউপ। একদম চুউপ মাইরা থাইকেন। খালি কোতদূর হেই কাম করনের মতো শব্দ দিয়েন। আমি আপনার উপরে উঠতাছি, এমন কইরা আপনারে আঞ্জা কইরা ধরুম আপনারে দ্যাখোন যাইবো না। বুকের ওপর থেকে আঁচল খসিয়ে দেয় ময়না ত্রস্ত হাতে। খসিয়ে দেয় ঘাড়ের কাছের বিড়ার মতো ভারী খোঁপাটা। ময়নার কোমর পর্যন্ত লম্বা মোটা গোছার ঘনকালো চুল ছড়িয়ে পড়ে পিঠের চারপাশে। সংগমের সময় এলোমেলো হয়ে গেছে এভাবে টেনে দেয় ঘাড়ের দুপাশে। লুকিয়ে যায় মানুষটার মুখ চুলের গভীরে, বুকের তলে। হাঁটু পর্যন্ত টেনে তোলে শাড়ির অংশ। শাড়ির আঁচলের একাংশ যেন বেখেয়ালে খসে গেছে, খসে যাওয়া সেই অংশের ফাঁক দিয়ে ওর স্তনদুটো  আব্রুহীন। ডাসা বেলের মতো বসে আছে রাতের দুধ জমা টনটনে স্তন দুইখানা।

মাটিতে কান পেতে শুয়ে থাকলে বহুদূরের শব্দমালা কানে প্রবেশ করে অতি দ্রুত। কয়েক জোড়া পায়ের দৌড়ানোর শব্দ শুনতে পায় ময়না এবং তার দেহের তলে পড়ে থাকা মানুষটা। থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে মানুষটা ময়নার দেহের তলে। তাকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে হয় না হেই কাম করনের মতো শব্দমালা। প্রাণের ভয়ে বুকের ভেতর সৃষ্টি হয় অদ্ভুত ঘোঁতঘোঁত শব্দ। সে যেন পারলে একেবারেই আড়াল হয়ে যেত ময়নার দেহের তলে।

ময়নার দেহখানি মৃদু মৃদু দুলে ওঠে মানুষটার দেহের ওপর। ময়লা স্যাঁতসেঁতে ধোকলা ঢাকা দেহের পাশে এসে থমকে দাঁড়ায় কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ। অন্ধকারে দুই জোড়া পায়ের উপস্থিতি অনুভব করে ময়নার শিরদাঁড়া দিয়ে পিলপিলিয়ে ওঠানামা করে অজানা ভয়। খুব সাবধানে উঁকি দেয় ময়না। মুহূর্ত মাত্র। কাঁথাটা সে এমন করে সরিয়ে দেয় যেন অসতর্কতার কারণে তার দেহের ওপর থেকে অনেকখানি সরে গেছে। কিন্তু সে তার দেহের তলের মানুষটাকে সাবধানে আড়াল করে রাখে তার ধোকলা, শাড়ি, খসে পড়া শাড়ির আঁচল আর ঘনকালো এলোচুলে। সংগমের চরম মুহূর্তের অভিব্যক্তির প্রকাশ রেখে ময়না এমন ভাব দেখায় যেন সে দ্বিধা লজ্জায় দিশাহারা। অস্থির হাতে স্তন ঢাকার প্রয়াস চালায়। ময়না হাঁপায়, হাঁপাতে গিয়ে যেন দুলে দুলে ওঠে স্তনযুগল। অনেকটা নগ্ন তার স্তনদুটি, ময়নার দুই চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁটদুটো ফাঁকা, প্রায় হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ।   

ময়নার দৃষ্টি দ্রুত ওঠানামা করে সামনে দাঁড়ানো দুটি যুবকের ওপর। ভীরু লাজুক দৃষ্টি আড়াল খোঁজে, কিন্তু আচরণে ক্ষিপ্ত। যুবকদুটির উদ্দেশে ময়না শ্লেষ মেশানো, কিন্তু যন্ত্রণা জড়ানো কণ্ঠে বলে—কী হইলো, কী চান আপনারা, আল্লা কি দুইনার কোথাও নাই? এই কথা বলে ময়না শাড়ির আঁচল তুলে নিজের মুখ ঢাকে। এই আড়ালের নিপুণতায় আরও আড়াল হয় তার দেহের তলের মানুষটা। আল্লায় নইলে আমাগোরে বাড়িঘর দেয় নাই, কিন্তু আমগো কি আর কোনো কিচ্ছু দেয় নাই শরীলের। প্যাট চ্যাট, সখ আল্লাদ সব কি খালি আপনাগোর, বড় লোকগো? মাঝরাইতরে ফুটপথের কামকাইজও আপনাগো দ্যাখতে লাগবো? ফুটপথে পড়ে থাকা ময়নার মুখের ভাষা হয়তো হয়ে উঠেছে কঠিন কর্কশ। 

ময়নার নগ্ন দেহ, সংগমকালীন অবিন্যস্ত অভিব্যক্তি, কঠিন জিজ্ঞাসা হয়তো বিভ্রান্ত করে তোলে শিকারি যুবকদের। তাদের দুঃসাহসের ওপর ময়নার নগ্নরূপ হয়তো সৃষ্টি করে সংশয় লজ্জা! বিভ্রান্ত যুবকেরা মধ্যরাতের সংগমরত ফুটপাতবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকার পাপবোধে আক্রান্ত হয় অথবা হারিয়ে ফেলে মনোবল। ফুটপাতের এপাশের জমাট অন্ধকার আর দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা স্তূপের পাশ থেকে সরে যায় তারা দ্রুত।

মধ্যরাতের নীরবতার কারণে ময়না স্পষ্ট অনুভব করতে পারে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে পায়ের আওয়াজগুলো। যতক্ষণ পর্যন্ত পায়ের আওয়াজ শোনা যায় ময়না তার নগ্ন দেহের তলে আড়াল করে রাখার দুঃসাহসিক প্রয়াস চালায় অচেনা মানুষটিকে। কারণ তখন ময়নার কানের কাছে ক্রমাগত বাজতে থাকে মানুষটার বাঁচার আকুতি। নগ্নতা ও সাহসে ভর করে দীর্ঘ সময় ময়না একই ভঙ্গিতে আড়াল করে রাখে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়া মানুষটাকে। রাতজাগা প্রাণীর মতো মাটিতে কান পেতে যখন নিশ্চিত হয় মানুষটা শঙ্কামুক্ত, তখন সে ভ্যাসভ্যাসে কণ্ঠে বলে—এ্যামনেই থাকেন, এখন উডনের কাম নাই। ওত পাইতা থাকতে পারে ধারেকাছে। আজান দিলে উইঠা যাইয়েন গিয়া, রাইতটা পার হউক।

ময়নার মতো ফিসফিসিয়ে লোকটা বলে—আইচ্ছা, তুই আমার বাপের জন্মের উপকার করলি, জানে বাঁচাইয়া দিলি আমারে! তর আইজকার এই ঋণ শোধ দিতে পারুম না আমি আমার এই এক জীবনে। তুই আমারে প্রাণে বাঁচাইছস! আমি এইটা কোনো দিনও ভুলুম না! এই এইখানেই তো থাকোস। ফাঁক বুইজা আসুমনে দিনের বেলা। তরে ঠকামু না দেখিস, কী নাম তর? নামটা খালি কঅ। 

কাঁথার একপাশ ধরে টান দেয় ময়না এবার। গড়িয়ে নামে লোকটির দেহের ওপর থেকে। থাউক, এত কথার কাম নাই, কিচ্ছু দিতে লাগবো না আমারে। ফুটপথে ঘুমাই প্যাটের দায়ে, কিন্তু নড্ডি না, মনে রাইখেন এইডা। য্যামনে আইছেন যান গিয়া ত্যামনেই। খালি দেইখেন আপনার প্যান্টের উপরে মাসিকের রক্ত লাগছে কি না। সহজে উঠে না মাসিকের রক্তের দাগ।