কুমিল্লায় এ বছর ৮০ হত্যাকাণ্ড, পারিবারিক কলহেই বেশি

‘মুরগি চুরি’, ‘রুম মেটের সঙ্গে ঝগড়া’, ‘পাতা কুড়ানো’, ‘মাইক্রোবাসের ভাড়া’, ‘গাছ কাটা’ ও ‘নামাজের জন্য ডাকা’সহ নানান কারণে এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৭৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লায়। চলতি মাসের প্রথম ৯ দিনে আরও চারটি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৮০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

কুমিল্লা জেলা পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে পারিবারিক কলহ ও জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে। যার সংখ্যা ২৪টি। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ১৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া অজ্ঞাত কারণে খুনের শিকার হয়েছেন ১২ ব্যক্তি। ঘাস কাটা নিয়ে তর্ক, রুমমেটের সাথে ঝগড়া, পাতা কুড়ানো, মাইক্রোবাসের ভাড়া, গাছ কাটা, মসজিদে নামাজ পড়তে ডাকাডাকির কারণে কথা কাটাকাটির জেরে খুন হয়েছেন ছয় জন। ভারতীয় সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন একজন। পুরাতন মোবাইল কেনাকে কেন্দ্র করে খুন হন একজন। মানসিক ভারসাম্যহীন মা তার ১৩ মাসের শিশুকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে এবছর। 

এছাড়াও মাদ্রাসার শিক্ষকের বেত্রাঘাতে ১২ বছরের ছাত্র খুন হয়, কিশোর গ্যাং কর্তৃক খুনের ঘটনা ঘটেছে দুইটি, প্রেম সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ডের শিকার একজন, বন্দুকযুদ্ধে হত্যাকাণ্ড একটি, পরকিয়ার ঘটনায় খুন দুইটি, গাড়ি চাপা দিয়ে খুন একটি, মুরগি চুরিকে কেন্দ্র করে একটি, মাদকাসক্ত হয়ে বন্ধুর হাতে খুন একজন, জমি বিক্রির পাওনা টাকা নিয়ে হত্যাকাণ্ড একটি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হয়েছে দুইটি খুন, রাস্তা নির্মাণ নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের হাতে খুন একটি, মোটরসাইকেল ক্রয়কে কেন্দ্র করে হত্যা একটি, চুরি করাকালে গণপিটুনিতে হত্যা দুইটিসহ আরও নানান কারণে খুনের ঘটনা ঘটেছে।

আরেকটি সূত্র জানায়, পুরো বছরের খুনের ৮০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহার নামীয় আসামি ২৭১ জন। যার মাঝে গ্রেফতার হয়েছে ১২২ জন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে ৭৬ জন। যেগুলোর ২৪টি মামলা চার্জশিট আদালতে দেওয়া হয়েছে এবং ৫২ মামলার তদন্ত চলমান। 

বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পারিবারিক কলহ ও সম্পত্তির বিরোধ নিয়েই খুন হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এই পরিমাণ খুনের নেপথ্যে কী ও কীভাবে তা হ্রাস করা সম্ভব; এবিষয়ে জানতে কথা হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লা জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সম্পদ ও সম্পত্তির দাম দিন দিন অনিয়ম তান্ত্রিকভাবে বাড়ছে। যা ন্যায্য নয়। যার লাগাম সরকার বা সমাজ কেউই ধরে রাখতে পারছে না। যার কারণে মানুষের ভোগবিলাস আর লোভের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই মানুষ শুধু চায় আর চায়। তাছাড়া আমাদের চাওয়া পাওয়ার মাত্রাও দিন দিন আকাশচুম্বী হচ্ছে। অন্যের জিনিসে আমাদের জোর খাটানো ঐতিহ্য হয়ে যাচ্ছে। তাই সম্পত্তির লোভে কেউ কাউকে খুন করতেও দ্বিধা বোধ করে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ সমস্যার সমাধানের জন্য আদালতে যায়। মামলা মোকদ্দমায় জড়ায়। দেখা যায় একটুকরো সম্পত্তির মামলায় চার টুকরো সম্পত্তি খোয়ায়। এতে মানুষের আইনের প্রতি আস্থা কমছে। এসব সমস্যা খালি চোখে না দেখা গেলেও এগুলোই মূলত সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। তাই খুনসহ সকল অপরাধ কমাতে মামলার দ্রুত সমাধান, সামাজিক সচেতনতা ও পারিবারিক শিক্ষা মূখ্য ভূমিকা রাখবে।’

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ এবং অপারেশন) খন্দকার আশফাকুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ সবগুলো ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে। কিছু মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি মামলার তদন্ত চলমান। বাকি মামলার তদন্ত শেষ হলেই রিপোর্ট দেবো।’

পারিবারিক কলহ ও সম্পত্তির বিরোধের ঘটনায় সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খুনসহ সকল অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।’