কর্কটগ্রাসে অস্তাচলে ‘ফুটবল সম্রাট’, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দিয়েগোর সঙ্গে জমে উঠবে আড্ডা

সব্যসাচী বাগচী 

সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? পেলে (Pele) না দিয়েগো মারাদোনা (Diego Maradona)? সেটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে ‘ফুটবলের সম্রাট’ যে পেলে সেটা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। ‘কালো মানিক’ খ্যাত পেলেকে বলা হয় ‘ফুটবলের সম্রাট’। অনেকে আবার ভাবতে পারেন পেলে যদি সম্রাট হন তাহলে মারাদোনা কি? মারাদোনা হলেন ‘ফুটবলের রাজপুত্র।’ কাকতালীয়ভাবে দু’জনেই প্রয়াত। তাও আবার মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক তাঁর দরজা চিরতরে বন্ধ করেছিলেন ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর। কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত পেলে-র ইনিংস শেষ হল ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে। 

১৯৭৯ সালের এপ্রিলে প্রথম বার দেখা হয়েছিল তাঁদের। সেই সময় মারাদোনার বয়স ১৯ বছর। বয়সে দুই দশকের বড় ফুটবল কিংবদন্তি পেলে সেদিন মহাসম্ভাবনাময় কিশোরটিকে উপহার দিয়েছিলেন ঘড়ি। কাঁধে হাত দিয়ে দিয়েছিলেন এক দামি উপদেশ, ‘কেউ যদি তোমাকে সেরা বলে, পাত্তা দিও না। সব সময় নিজেকে বলে যেও, তুমি সেরা নও। উদীয়মানের মধ্যে সাফল্যের খিদে জাগিয়ে রাখতে অব্যর্থ টিপস। সেদিন কারও কল্পনাতেও ছিল না একদিন এই দুই অসমবয়সি তারকার মধ্যে তুলনাকে ঘিরে দ্বন্দ্বে মেতে উঠবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। ভুল! যেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে ফুটবল বিশ্ব।

মৃত্যু সবসময় বিষাদের। বড্ড যন্ত্রণার। যে একেবারের জন্য যান, তিনি কষ্ট পান। তাঁর কাছের মানুষগুলো, তাঁকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কষ্ট হয়তো আরও অনেকটা বেশি। তবে সব মানুষের চলে যাওয়া নিয়ে কষ্ট পেতে নেই। পেলে-র মতো মানুষের জন্য একেবারেই নয়। তাঁর প্রিয় ব্রাজিল (Brazil) যখন কাতার বিশ্বকাপে (FIFA Qatar World 2022) হেক্সা করার স্বপ্ন নিয়ে লড়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই পেলে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শেষ যুদ্ধটা লড়ছিলেন। কিন্তু এবার আর কর্কট রোগের বিরুদ্ধে ম্যাচটা জিততে পারলেন না। ‘মৃত্যু’ নামক ডিফেন্সের জালে চিরতরে আটকে গেলেন। ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মারাদোনার কাছে চলে যাওয়ার সময় বয়স হয়েছিল ৮২। রেখে গেলেন পরিবার-সহ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা অগণিত শুভানুধ্যায়ীদের। 

তবে দুই প্রবাদপ্রতিম একে অপরের কাছে চলে গেলেও, ইগোর লড়াই ছিল তুঙ্গে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় মারাদোনার আত্মজীবনী। তাতে সরাসরি আঙুল তোলা হয়েছিল পেলের দিকে! দিয়েগোর অভিযোগ ছিল, সতীর্থ গ্যারিঞ্চা যখন অ্যালকোহল আসক্তির কবলে পড়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছিলেন, উদাসীন ছিলেন পেলে। স্বাভাবিক ভাবেই এমন কথায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন পেলে। ‘বদলা’ নিতে পেলের জীবনীতে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেলসো গ্রেলেটও মারাদোনাকে কটাক্ষ করে বসেন।

যদিও এত কিছুর পরেও পেলে-র জীবন কিন্তু মারাদোনাকে ছাড়া পূর্ণ হয় না। দুজন আলাদা দেশের মানুষ। দু’জনের বয়সের ফারাক অনেকটা। ১৯৬০ সালে মারাদোনার জন্ম। পেলে ততদিনে একটা বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছিলেন। পেলে যেখানে তিনটি বিশ্বকাপ তাঁর বাড়ির ক্যাবিনেটে সাজিয়ে রেখেছিলেন, সেখানে মারাদোনার ঝুলিতে একটা বিশ্বকাপ। তবুও দুই গ্রেটের মধ্যে একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়া এবং ইগোর লড়াই লেগেই ছিল। 

সেটা ফুটে উঠেছিল পেলে-র আত্মজীবনীতেও। ১৫ কেজি ওজনের একটি বই লিখেছিলেন পেলে। সেখানে পেলে লিখেছিলেন, তিনি নাকি পুরো ফুটবলজীবনে মোট ১২৮৩টি গোল করেছিলেন! সেইজন্য বইটির নাম রেখেছিলেন ‘১২৮৩’। অবশ্য সেই আত্মজীবনী নিয়েও ছিল চরম বিতর্ক। একবার মারাদোনাকে সেই আত্মজীবনীর অদ্ভুত নাম ও পেলে-র করা ১২৮৩টি গোল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, আর্জন্টিনার মহা বিতর্কিত মানুষটি বলে দিয়েছিলেন, ‘পেলে তো নিজের বাড়ির উঠানে ওর ভাইপোর সঙ্গে খেলে গোল দিত!’  

যদিও পেলে ছিলেন চুপ। একটিও শব্দ খরচ করেননি। পেলের এই বইতে রয়েছে তাঁর ফুটবলজীবনকে মূর্ত করা দুর্লভ ছবির সমাহার। ছবির সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। রয়েছে ৫০০ পৃষ্ঠায় ১২৮৩টি টেক্সট। বইটি ছাপানো হয়েছে ১২৮৩ কপি। প্রতিটি বই বিখ্যাত ফুটবলারদের অটোগ্রাফ-সংবলিত। প্রকাশিত হওয়ার সময় বইটির মূল্য ছিল এক হাজার ২২৫ ইউরো। ব্রাজিল ছাড়াও আমেরিকার নিউইয়র্ক, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, দুবাই ও যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বইটি বিশেষ কিছু লাইব্রেরি থেকে পাওয়া যাবে। 

আরও পড়ুন: Pele Passes Away: সম্রাটহীন ফুটবল! ৮২ বছরে জীবনাবসান পেলের

আরও পড়ুন: Ronaldo | Messi | Pele: ‘রাজা পেলে’র ভালোবাসাকে কুর্নিশ ক্রিস্টিয়ানোর, তিন অক্ষরের শ্রদ্ধার্ঘ লিওর

দুই মহাতারকার মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে কয়েক বছর পরে। ‘শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়’ বেছে নিয়ে অনলাইন ভোট নেয় ফিফা। বিপুল ব্যবধানে পেলেকে হারিয়ে সেই খেতাব জিতে নেন মারাদোনা। কিন্তু পেলের অনুরাগীরা দাবি করলেন, যেহেতু ভোট দিয়েছে আমজনতা, তাই বহু আগে অবসর নেওয়া পেলেকে গুরুত্ব না দিয়ে সদ্য অবসর নেওয়া মারাদোনার পক্ষেই তাঁদের ভোট যাবে এটা স্বাভাবিক। এরপর ফিফা আবার একটি ভোট নেয়। এবার সাংবাদিক, কোচ ও ফুটবলের সঙ্গে যুক্তদেরই কেবল ভোট দিতে বলা হল। সেই ভোটে আবার জিতে গেলেন পেলে। ইতিহাসের অমোঘ ইশারায় আসলে অমীমাংসিতই যেন রয়ে গেল এই তুলনা।

পরবর্তী কয়েক বছর ধরেও সেই তিক্ততা অব্যাহত ছিল। ২০১৭ সালে পেলে জানিয়ে দেন, তাঁর সঙ্গে মারাদোনার তুলনা অনুচিত। তিনি বলেন, ‘আমরা কখনওই বলতে পারি না মারাদোনা একজন দারুণ হেডার। ও হেড থেকে খুব বেশি গোল করেনি।’ সেই সঙ্গে মারাদোনার কেবল বাঁ পায়ে ফুটবল খেলা নিয়েও তাঁর কটাক্ষ,’লোকে যখন তুলনা করে আমি রসিকতা করি এটা নিয়ে। ও অবশ্যই মহান খেলোয়াড়। কিন্তু আপনাদের পেলে ও মারাদোনার তুলনা করা উচিত নয়।’ তবে সেই সঙ্গে ফুটবল সম্রাট দাবি করেছিলেন, এখন তিনি ও দিয়েগো ‘ভাল বন্ধু’।  

দু’জন যখনই মুখোমুখি হতেন, রসিকতা করতেন। একবার পেলে বলেছিলেনন, ‘মারাদোনা, আমার সঙ্গে তুলনীয় হতে গেলে তোমাকে আরও ১ হাজার গোল করতে হবে।’ উত্তরে মারাদোনা বলেছিলেন, ‘সেটা আমি করতে পারব না। তবে তাতে কিছু যায় আসেও না।’ 

আমাদের এই দুনিয়া দুই কিংবদন্তির লড়াই অনেক দেখেছে। এবার স্বর্গে গিয়েও দুই ‘বুড়ো’ একে অপরকে টেক্কা দেবেন। চলবে ফুটবল নিয়ে আলোচনা। লাতিন আমেরিকার দুই কিংবদন্তি আলোচনা করবেন ৯০ ফুটবল নিয়ে। উঠে আসবেন লিওনেল মেসি, নেইমার ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। কিলিয়ান এমবাপেও বাদ যাবেন না। কারণ পেলে-যে ২৩ বছরের ফরাসি স্ট্রাইকারকে বড্ড ভালোবাসতেন। কয়েক বছর আগে তো এমবাপের স্কোরিং এবিলিটি দেখে বলেই ফেলেছিলেন, ‘ছেলেটা একেবারে আমার মতো খেলে’। 

সেই ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে পেলে-র অপেক্ষায় বসে ছিলেন। চিরপ্রতিদ্বন্দী বলে কথা। দিয়েগোর অপেক্ষার পালা শেষ। পেলে-র বিশেষ ফ্লাইট স্বর্গের দিকে উড়ে গিয়েছে। বার্তা পেয়ে গিয়েছেন ‘ফুটবলের রাজপুত্র’। তাই মারাদোনা ঠিক তাঁর পাশেই ‘ফুটবলের সম্রাট’-এর জন্য চেয়ার পাতলেন। এবার জমে উঠবে আড্ডা। এই হাই-প্রোফাইল আড্ডা চলবে আদিঅনন্ত কাল ধরে…..

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)