‘যখন তারা ধর্ম নিয়ে কথা বলে, আমি তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন করি’

আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন সোমালিয় সাহিত্যিক নুরুদ্দিন ফারাহ রাজনৈতিক সচেতন সমৃদ্ধ লেখালেখির জন্য পরিচিত। তরুণ বয়সেই সিয়াদ বারির (সোমালিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি) সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় তাকে নির্বাসনে যেতে হয়। তার লেখা তিনটি ধারাবাহিক সোমালিয়ার ইতিহাসকে নিবিড়ভাবে হাজির করে, যেখানে তিনি সোমালিয় জীবনের আন্তঃসংযোগগুলোকে কাটছেঁড়া করে দেখিয়েছেন: একনায়কত্ব, পরিবার, ঐতিহ্য এবং ধর্ম বিষয়ে। ক্যারিয়ারের শুরুতে বিখ্যাত হেইনম্যান আফ্রিকান রাইটার্স সিরিজে এসব প্রকাশিত হওয়ায় ফারাহ দেশটির লেখকদের দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

সেই নুরুদ্দিন ফারাহ আসছেন ঢাকা লিট ফেস্টে। জীবনের গল্প শোনাতে। সরাসরি সেই গল্প শোনার আগেই বাংলাদেশী পাঠকদের জন্য এই সাহিত্যিকের একটি বিশেষ সাক্ষাতকার তুলে ধরা হলো। জোহানসবার্গ রিভিউ অব বুকস (জেআরবি)-এ প্রকাশ করা হয় এটি। ফারাহ-এর কাজের নানা দিক নিয়ে সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন লেবোহাং মোজাপেলো। যিনি জোহানসবার্গের একজন সম্পাদক, লেখক, গবেষক ও কবি

জেআরবি: আমি সম্প্রতি নাইরোবির চেচে বুকশপে আপনার উপন্যাস ‘ফ্রম আ ক্রুকড রিব’-এর পঞ্চাশতম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। আপনি সেখানে বলেছিলেন, যখন এই উপন্যাসটি লেখেন তখন আপনি পড়ালেখার জন্য ভারতে ছিলেন। উপন্যাসের কারণে কি সোমালিয়া সরকারের সঙ্গে কোনোরকম ঝামেলায় পড়েছিলেন তখন?

নুরুদ্দিন ফারাহ: আমি যখন দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আ নেকেড নিডল’ লিখেছিলাম, তখন সমস্যায় পড়েছিলাম এবং তার চেয়েও বেশি সমস্যায় পড়েছিলাম যখন আমি ‘সুইট অ্যান্ড সাওয়ার মিল্ক’ প্রকাশ করি। আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিলো যে, যদি সোমালিয়ায় যাই তাহলে মেরে ফেলা হবে। তখন আমি আর না ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। সেটা ১৯৭৬ সাল। এবং আমি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ফিরিনি। আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছি, পুরো পৃথিবীকে আমার ছোট্ট গ্রাম ভেবে নিয়েছি। এই বাইরে বাইরে থাকার কারণে আমি বরং সোমালিয়াকে নিয়ে বেশি লিখেছি, মনে হয়েছে সেই ভালো।

জেআরবি: সেটা কেমন?

নুরুদ্দিন ফারাহ: আপনার সামনে যখন কিছু ঘটছে তখন এমন অনেক কিছু আসে যা আপনি গ্রহণ করেন। সেসময় আপনার থকথকে আবেগ থাকে। আপনি যদি মোগাদিশু নিবাসী হন এবং আপনার খুব ভালো বন্ধুটিকে আটকে রাখা হয়, তবে আপনি নিজের জন্য চিন্তা করতে শুরু করবেন। এমনকি যদি আপনি নিজের জন্য চিন্তা নাও করেন, আপনার মা, বাবা, স্ত্রীর জন্য চিন্তায় পড়বেন। আর তাই সবকিছুই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। আপনি যেখানে আছেন সেটার সঙ্গে সোমালিয়ার মধ্যকার পার্থক্যগুলো না জানলে নিরাপদ পরিবেশে ঘুম থেকে জেগে উঠলেও আপনি ততটা স্পষ্টভাবে ভাবতে পারবেন না।

জেআরবি: আপনি বললেন, সোমালিয়া থেকে দূরত্ব আপনাকে কিছুটা স্পষ্টতা দিয়েছে। কিন্তু সেটা ১৯৭৬ সালে। কিছু সময়ের পর আপনার কি মনে হয়েছিল দেশ থেকে আপনি হয়তো যোগাযোগের বাইরে চলে যাচ্ছেন?

নুরুদ্দিন ফারাহ: না, কারণ আমি আফ্রিকাতেই থাকতাম। এবং সোমালিয়ায় যা ঘটছিল তা অন্যান্য অনেক দেশেও একইভাবে ঘটছিল। আমার মনে আছে ১৯৮৩ সালে জিম্বাবুয়ে গিয়েছিলাম এবং খুবই সামান্য কারণে আমাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিলো। আমি আমার কিছু জিম্বাবুয়ের লেখক সহকর্মীকে বলেছিলাম যে, দেশটি একনায়কতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে।

চেঞ্জেরাই হোভ (Chenjerai Hove)সহ কয়েকজন লেখক অনেক গলাবাজি করেছিলো তখন। তারা আমাকে অতৃপ্ত লেখক হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলো। জিম্বাবুয়ের লেখকদের মধ্যেও সেটা ছড়িয়ে যাচ্ছিলো, কারণ তারা বলতে চেয়েছিলো রাষ্ট্রপতি মুগাবে ছিলেন দেশের ভালো মানুষ। যখন প্রান্তিক এলাকায় এমন কিছু না ঘটে তখন আমি ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম। এরমধ্য দিয়ে আমি সোমালিয়ায় শত্রু তৈরি করি এবং আমার এই স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা স্বভাবের কারণে অন্য দেশ থেকেও আমি বিতাড়িত হয়েছিলাম।

জেআরবি: তাহলে স্বৈরাচার নিয়ে আপনার লেখা শুধু সোমালিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি? আপনি অন্য জায়গাতেও এটি দেখতে পেয়েছেন এবং সেটা নিয়ে কথা বলেছেন?

নুরুদ্দিন ফারাহ: স্বৈরাচার অধ্যয়ন এবং এটি সম্পর্কে লিখতে ও বিশ্লেষণ করার জন্য একধরনের পাগলামি বা সাহস দরকার হয়। আমি জানি না, আমি অন্য কোনও লেখকের কথা ভাবতে পারি না যারা কিনা তাদের দেশের ইতিহাসকে দৃঢ়তার সাথে অনুসরণ করেছে। অন্য কথায়, যদি কেউ একের পর এক আমার বই পড়ে, প্রতিটি বই সোমালিয়ার ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। 

আমাকে গাম্বিয়া থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল, কারণ আমি সাহস করে বলেছিলাম যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি তার জনগণের চেয়ে গলফ খেলায় আগ্রহী বেশি! উগান্ডায় আমি ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপ্রধান, (ইওওয়েরি) মুসেভেনির সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম। যিনি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন- তিনি যখন দেশের বাইরে ছিলেন তখন আমি বলেছিলাম- ‘একজন লোক আছে ফারাহ নাম। প্রফেসর ফারাহ। যিনি একজন অতিথি। তিনি আসলে জানেন না তার জন্য কোনটা ভালো। যদি তিনি না জানেন যে তার জন্য কী ভালো, আমরা তাকে সেটা বুঝিয়ে দেবো।’ 

অবশ্যই, আমি সেটি করিনি কারণ আমাকে অনেকগুলো দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এখন আমি দাদুর মতো আচরণ নিয়েছি: আমি আমার স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবি এবং কাজ করি। এবং ছোটরা আমার কাছ থেকে জানুক সেটা চাই।

জেআরবি: ‘ফ্রম আ ক্রুকড রিব’-এর একটি দিক যা প্রায়শই উঠে আসে এবং আলাপচারিতায় বেশ কয়েকবার এটিকে একটি নারীবাদী বই হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিলো। আপনি যে সময়ে কিশোরীকাল ও আফ্রিকান নারীত্ব সম্পর্কে লিখছিলেন তখন কিনা বেশিরভাগ আফ্রিকান পুরুষ লেখকরা ধারাবাহিকভাবে ছেলেদের বাল্যকাল নিয়ে লিখছিলেন। বই কি নারীবাদী হতে পারে?

নুরুদ্দিন ফারাহ: আমি আমার বইগুলোকে কখনও নারীবাদী বলিনি। আমি শুধু যেটুকু বলতে পারি তা হলো, সমাজ আমার মায়ের সাথে কী আচরণ করতো, সমাজ আমার বোনদের সাথে কীভাবে আচরণ করেছে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আমার ছিল। আমরা, পুরুষরা কীভাবে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি যখন কিনা মেয়েদের বিনোদনের কোনও সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না। যে বোনটি আমাকে ফলো করে তাকে কীভাবে রান্নাঘরে রাখা হয়েছিল যখন কিনা তার ছোট ভাইটিকে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। আমি আমার বোনের লেখাপড়ার জন্য অর্থ ব্যয় করব কি না, তা নিয়ে আমার বাবা এবং আমার মধ্যে লড়াই চলছিলো, কারণ আমার বাবা মেয়েটির পেছনে ব্যয় না করে আমাকে টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি নারীবাদী বলে এটা করছিলাম তা নয়। করেছিলাম ন্যায্যতার জন্য। আপনি ন্যায্যতার দাবি তুলেছেন বলে কি আপনি নারীবাদী?

জেআরবি: আপনার উপন্যাসের মধ্যে আমার প্রিয় সার্ডাইনস এবং আমার প্রিয় চরিত্র মেদিনা। এই বইটি আপনার অন্যান্য কাজের চেয়ে নারীবাদ বিষয়ে সরাসরি কথা বলে। কীভাবে তিনি তার মেয়েকে বড় করেন এবং কীভাবে তিনি নারীবাদের অনুশীলনে জীবনযাপন করেন সে সম্পর্কে মেদিনা খুব সরব।

নুরুদ্দিন ফারাহ: আচ্ছা, আমি এই কথাটি বলতে চাই যে আমি সাধারণত টেক্সটকে বিচার করতে পছন্দ করি না, খোদ টেক্সট তার কথা বলে। কিন্তু আপনি এইমাত্র যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলতাম। কারণ টেক্সটে জেনারেলের সামান্যতম বক্তব্য নেই, বক্তব্যের ক্ষমতা মেদিনার কাছে। যাইহোক, তিনি যা করেন তা হলো অন্যান্য চরিত্রের চিন্তাভাবনায় হস্তক্ষেপ করেন। মেদিনার শাশুড়ি ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান এবং তার মেয়ের খৎনা করতে চান, যা মেদিনা প্রত্যাখ্যান করেন। একে কি স্বৈরাচার আচরণের সাথে তুলনা করা যায়? পিতৃতন্ত্রের অনুপস্থিতি মাতৃতান্ত্রিকতা সৃষ্টি করে যে কিনা তখন সেই ঐতিহ্যবাহীনিপীড়ক ব্যবস্থার প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। এবং আমি আপনাকে বলছি পুরো সোমালীয় পরিবার ব্যবস্থাই কর্তৃত্ববাদী। আপনি বিচ্ছিন্ন হবেন, বহিষ্কৃত হবেন, বিশ্বাস থেকে, পরিবার থেকে, যদি না আপনি গোষ্ঠী, পরিবার এবং বিশ্বাসের সীমারেখা এঁকে না দেন।

জেআরবি: তারপরে আপনি যা বললেন, পরিবার ও রাষ্ট্র একে অপরকে প্রতিফলিত করে। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কর্তৃত্ববাদী পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের অস্তিত্বকে দৃশ্যমান করে। আর পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে যা ঘটে তা স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে দৃশ্যমান করে।

নুরুদ্দিন ফারাহ: হ্যাঁ, একদম। আমি যখন ‘সুইট অ্যাণ্ড সাওয়ার মিল্ক’ লিখেছিলাম তখন আমাকে না পেয়ে সিয়াদ বারি (সোমালিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি) কী করেছিল? সিয়াদ বারি আমার বাবাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘একজন খাতনা না করা কিশোর (এর চেয়ে রূঢ় ভাষায়) এবং তার ও আমার মধ্যে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা সোমালিয়ার বিষয়ে আলোচনা করতে পারি। আপনি যত অর্থ চান দিতে প্রস্তুত, আপনাকে আপনার ছেলের সাথে কথা বলতে হবে।’ এবং যখন আমার বাবা এই বার্তাটি আমাকে পাঠালেন তখন আমি তাকে বলেছিলাম, ‘আমাকে আপনার বলার কিছু নেই।’ 

তাহলে, আমি কি পুরুষতন্ত্রের সাথে লড়াই করছিলাম? আমি জানি না, কিন্তু আমি এটা জানি যে, আমি আমার চিন্তার ওপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলাম। যখন আমি সেই হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলাম তখন সেটিকে ‘পিতৃতন্ত্র’ নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। আমি শুধু জানতাম যে এই জিনিসটি একটি শারীরিক রূপ এবং একটি আদর্শিক রূপ নিয়েছে, তাই আমাকে উভয়ের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল। আমার বাবার সাথে লড়াই করা যিনি স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং এর ফলে পিতৃতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছিলো। 

জেবিআর: একইভাবে সার্ডাইনসে, যখন যুবতীকে অপহরণ করা হয় এবং তার বাবার কাছে বার্তা দিতে তাকে জোরপূর্বক খৎনা করানো হয়, তখন একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য প্রমাণ করতে নারীর শরীরে খুব ব্যক্তিগত পরিসরে অপরাধ ঘটানো হয়। যা নিপীড়নের লৈঙ্গিক বিভাজনের উপস্থিতিও বটে।

নুরুদ্দিন ফারাহ: আফ্রিকান স্বৈরশাসন নিয়ে তিনটি ধারাবাহিক বইয়ের (সুইট অ্যাণ্ড সাওয়ার, সারডাইন্স, ক্লোজ সেসিমি) মূলভাবনা শরীর নিয়ে উপন্যাস। কারণ আপনি একজন ব্যক্তির মনের ওপর অত্যাচার করতে পারেন না, তারা শরীরকে নির্যাতন করে। তারা মেয়েদের অপহরণ করে এবং তাদের সাথে ভয়ানক সব কাজ করে এই ভেবে যে, এই বিশেষ ব্যক্তি কর্তৃপক্ষের প্রতি নতি স্বীকার করবে। যেটা সবচেয়েগুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমি আপনাকে বলতে পারি, যেহেতু আমি প্রায়শই ট্রিলজি লিখি, ট্রিলজির প্রথম অংশটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষালি। দ্বিতীয় অংশটি সাধারণত নারীর এবং তৃতীয় অংশটি আপনি আসলে আগে বুঝতে পারবেন না। এই ভূমিকাগুলি মানচিত্র, উপহার এবং গোপনীয়তায় অদলবদল করা হয়। যদিও গোপনীয়তার কারণে মূল উপলব্ধিটি পুরুষ না নারীর তা নির্ধারণ করা হয় না। এবং এসব কারণেই আমার জন্য ট্রিলজি লেখা সহজ।

জেআরবি: ভাষার কথা বলতে গেলে, আপনি সোমালিতে না লিখে ইংরেজি বেছে নেওয়ার কারণ নিয়ে একবার একটি অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করা হয়েছিল। আপনার প্রতিক্রিয়াতে আপনি ভাষা সম্পর্কে নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো (Ngũgĩ wa Thiong’o) এর ধারনাগুলি নিয়ে কথা বলেছিলেন। আমি সেটি আরেকবার শুনতে আগ্রহী। 

নুরুদ্দিন ফারাহ: দেখুন, সোমালিয়া এক ভাষার একটি দেশ এবং কেনিয়া বিশ থেকে ত্রিশটি ভাষার দেশ। আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো আপনি যদি একজন কেনিয়ান হন তবে আপনাকে একটি ভাষায় লিখতে হবে, সেটা এমন ভাষা হতে হবে যেটা সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রত্যেকে অ্যাক্সেস করতে পারে। এমন কোনও ভাষা আছে কি? সুতরাং একটি অভিজাত ভাষা বেছে নেওয়ায় কোনও পার্থক্য তৈরী হয় না যে, এটা একটি ঔপনিবেশিক ভাষা বা এটা কিকুয়্যুর মতো আদিবাসীদের ভাষা।

শেষ পর্যন্ত, আপনার উচিত বইয়ের বিষয়বস্তুর প্রতি মনোযোগ দেওয়া, কোন ভাষায় লেখা হয়েছে সেটা নিয়ে না ভেবে এটি যথেষ্ট প্রগতিশীল ধারনাপ্রসূত কিনা এবং আদর্শগতভাবে ঠিকঠাক আছে কিনা সেটায় মনোযোগি হওয়া উচিত। ইংরেজি আমার চতুর্থ ভাষা, আমি অন্য আরও তিনটি ভাষার যে কোনও একটিতে লিখতে পারতাম কিন্তু লিখিনি। আমি সোমালিতে লিখলাম না কেন?

সোমালিতে বানান পদ্ধতি আবিস্কারের আগে থেকেই আমি ইংরেজিতে লেখা শুরু করি। আমি যখন লিখতে শুরু করি তখন আপনি চাইলেও সোমালিতে লিখতে পারতেন না। সোমালি একটি লিখিত ভাষা হওয়ার আগে ক্রুকড রিব (Crooked Rib) লেখা হয়েছে। (সোমালি ল্যাটিন বর্ণমালা আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭২ সালে গৃহীত হয়)। তাহলে কোন সময়টাতে আমার সোমালি ভাষায় লেখার কথা বলছেন?

যেমন বলেছি, প্রথম উপন্যাস লিখে আমি সমস্যায় পড়েছিলাম। তাই তখন আমি সোমালিতে লিখতে পারিনি, কারণ আমি সোমালিয়ায় ততদিনে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম- সংবাদপত্রে আমার নাম লেখা হতো না। এমনকি কোনও সংবাদপত্রে আমাকে উদ্ধৃত করে কিছু ছাপা হতো না। ফলে ইংরেজিতে লেখা ছাড়া আমার কোনও পথ খোলা ছিলো না।

জেআরবি: কেনিয়াতে কিকুয়্যু অভিজাত ভাষা হিসেবে বিবেচনা হতে পারে সেটা আপনি মনে করেন না?

নুরুদ্দিন ফারাহ: না, এটি একটি জাতিগত ভাষা। একদল লোক যারা বিশ্বাস করে যে তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি আছে এবং সেকারণে এটা তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় যারা লুও এবং কালেনজিন বা এরকম আরও ভাষায় কথা বলে। যদি তিনি সোয়াহিলিতে লিখতেন বা সোয়াহিলিকে একটি জাতীয় ভাষাহিসাবে প্রচার করতেন, তবে সেটি হতো একটি ভিন্ন গল্প, তার ধারণাগুলি কার্যকর হতে পারতো। কিন্তু আমি ততোটা বলতে চাই না, আপনি জানেন, নগুগি আমার বন্ধু!

জেআরবি: আপনি বলছিলেন যে এখনও এমন লেখকদের মুখোমুখি হননি যারা তাদের দেশের ইতিহাস, বিশেষ করে একনায়কত্বকে প্রশ্ন করে না, যেমন আপনি করেছেন…

নুরুদ্দিন ফারাহ: ধরুন জিম্বাবুয়েতে ডাম্বুডজো মারেচেরা। আমি মনে করি তিনি যদি বেঁচে থাকতেন এবং সেখানকার কর্তৃত্ববাদী শাসন নিয়ে লিখতেন তবে তার বইগুলি খুব, খুব আকর্ষণীয় হতো। আমি সম্প্রতি জিম্বাবুয়ের কারও লেখা পড়িনি এবং তাই আমি জানি না সেখানকার লেখকরা একনায়কতন্ত্র বিষয়ে লিখেছেন কিনা। আমাদের মধ্যেই আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ লেখকরা নিজেদের একটি বিশেষ লক্ষ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। এবং তারপরে এটি প্রজন্মের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সম্ভবত এটি আমার প্রজন্ম যারা স্বৈরাচারদের প্রতি আগ্রহী ছিল এবং এখনকার প্রজন্ম তেমন নয়।

জেআরবি: আপনার প্রজন্ম কী করলো?

নুরুদ্দিন ফারাহ: আমি বড় কিছু না, সেটাতে অবশ্যই আমি জোর দিবো। আমি নগুগি, আচেবে, সোয়েনকা প্রজন্মের না। আমি চেঞ্জেরাই হোভ এবং অন্য প্রজন্মেরও নই। তাই আপনি চাইলে আমাকে স্বতন্ত্র প্রজন্মের মধ্যে ফেলতে পারেন। যা আমাকে আলাদা করে তোলে তা হলো অন্যরা কী করেছে তা আমার জানা ছিলো। তারা ঐতিহ্য এবং মানুষের জীবনে ঐতিহ্যের স্থান সম্পর্কে চিন্তা করত। আমি এমন একটি জায়গা থেকে এসেছি যেখানে আমি প্রচলিত বা ঐতিহ্য বলে উল্লেখ করা বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করি। আমি এমন একটা জায়গা থেকে এসেছি যেখানে আমি বলি বড়রা সবকিছু নষ্ট করে ফেলেছিলো। গুটিয়ে ফেলেছে। আমি বিপথগামী। 

যে জিনিসটি আমাকে অন্য লেখকদের থেকে আলাদা করে তা হলো আমি আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় নির্বাসনে ছিলাম। যখন বেশিরভাগ আফ্রিকান লেখক ইউরোপীয় ইতিহাস এবং তাদের জাতীগত সংকীর্ণ সংজ্ঞার মধ্যে বাস করতো। সুতরাং একজন নাইজেরিয়ান ইওরুবা (আদিবাসী) হলেও ইংরেজিতে কথা বলবেন। অথচ আমি বহুসংস্কৃতি এবং বহুভাষিক পটভূমি থেকে এসেছি। আমি ইংরেজি এবং ইতালীয় বা ইংরেজি এবং সোমালি ভাষায় কথা বলি। কারণ আমি আরবি জানি, ইথিওপিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মাতৃভাষা আমহারিক জানি। আমি অনেককিছুর মিশ্রণ করেছি।

উত্তর আফ্রিকায় আমার লেখা বইগুলো বেশি সমাদৃত হওয়ার এটা একটা কারণ। কারণ এখন পর্যন্ত আমার কোনও বই দক্ষিণ আফ্রিকায় কেউ রিভিউ করেনি। আমি পরিচিতি পাওয়ার আগে পর্যন্ত ‘ক্রুক রিব’ বইটি কখনও কোথাও কেউ রিভিউ করেনি। 

জেআরবি: এটা উল্লেখ করায় আমি বেশ উৎসাহ বোধ করছি। উইটস ইউনিভার্সিটিতে আফ্রিকান সাহিত্য বিভাগে পড়াশুনা করার পর আমি আপনার কাজ বিষয়ে জানতে পেরেছিলাম কেবল স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ‘নুরুদ্দিন ফারাহ’ কোর্সে। যেখানে অন্যান্য লেখকদের বই আমাদের কোর্স ওয়ার্কের মাধ্যমে বিভিন্ন থিমের অধীনে পুরোটা পড়ানো হতো। 

নুরুদ্দিন ফারাহ: কারণ তারা জানে না আমার কাজগুলো নিয়ে কী করা যায়। আপনি কি জানেন মেকেহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বই কে পড়ায়? ধর্ম ডিপার্টমেন্ট। আর পশ্চিম আফ্রিকায়? দর্শন বিভাগ। এটি সেই বিপথগামীতারই অংশ। আমি যে মিশ্রণটি নিয়ে হাজির হয়েছি সেটা আসলে কোথায় ফিট করবে সেটাই বড় প্রশ্ন।

এই মিশ্রণটাই তাদের বিরক্ত করে। আমি একজন মুসলিম দার্শনিক, একজন হিন্দু দার্শনিক, একজন জার্মান দার্শনিককে উদ্ধৃত করতে পারি এবং বেশিরভাগ লোক অস্বস্তি বোধ করবে। কারণ তাদের উত্সগুলি সন্ধান করতে হবে এবং কোথায় উত্সগুলি খুঁজে পাওয়া যাবে তারা সেটাও জানে না।

আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে কেবল একজন ব্যক্তি আছেন যিনি আমার বই পড়াতে এবং সেটার সাথে বোঝাপড়া করতে পারেন। এটা স্বাভাবিক না। এবং যখন কেউ আমার নাম নেয়, সেটা সম্মানের। কিন্তু বেশিরভাগেরই আমার কাজের বিষয়বস্তু নিয়ে কোনও ধারণা নেই।

আমি অভিযোগ করতে পারি না। বইগুলো সুনাম কুড়িয়েছে কিন্তু জনপ্রিয় নয়। কেউ কেউ বলে, ‘তিনি কি সত্যিই আফ্রিকান?’ এর কারণ হলো আফ্রিকানদের একটি দ্বৈত পথ রয়েছে এবং যা এটি সহজ করে তোলে। তা হলো: আপনি যদি আফ্রিকান ঐতিহ্য জানেন তবে আপনি খ্রিস্টধর্ম জানেন। কারণ Ngũgĩ এবং Achebe খুব নির্দিষ্ট ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকান সংস্কৃতি এবং ধারণাগুলি নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু যখন এটা ফারাহর ব্যাপারে হয়, আপনাকে এর চেয়েও বেশি কিছু জানতে হবে।

জেআরবি: নাইরোবিতে একটি স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে কিছু সোমালি ছিল, যাদের মতে আপনার কাজ সোমালিয়ায় ধর্মকে খারিজ করে দেয়। তারা মনে করে, আপনি ধর্ম নিয়ে বেশি সমালোচনা করেন।

নুরুদ্দিন ফারাহ: আমার সত্যিকারের অনুভূতি হলো সোমালীরা পৃথিবীতে সবচেয়ে কম ধার্মিক। কীভাবে সোমালীদের কেউ একে অপরের ওপর ধ্বংসাত্মক কাজ পরিচালনা করতে পারে? যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেই গণহত্যা দেশের ভিতরে হয়েছে। যদি তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করত, যতটা তাদের উচিত, তারা একে অপরের ওপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তো না। বিশেষ করে মুসলিমরা। তাই যখন তারা ধর্ম নিয়ে কথা বলে, আমি তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন করি।

এটাও মজার, আমার লেখা ধর্মীয় উপন্যাস হলো ‘ক্লোজ সিসেম’—কেন মানুষ শুধু সেই চরিত্রগুলোই মনে রাখে যারা বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলে আর যারা তোলে না তাদের ভুলে যায় না?

আমার শেষ কথা হলো- যদি কোনও চরিত্র কিছু বলেও, সেটা আমি বলছি; তা কিন্তু না।