মানুষ প্রকৃতির চেয়ে দুর্বল: অমিতাভ ঘোষ

মানুষ প্রকৃতির চেয়ে দুর্বল উল্লেখ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাঙালি লেখক অমিতাভ ঘোষ বলেছেন, ‘প্রকৃতিকে ধ্বংস করার সক্ষমতা মানুষের নেই। মানুষ পরিবেশের যা-ই ক্ষতি করুক, প্রকৃতি তার সবটাই ফিরিয়ে দিবে। ফলে নিজেরা ভালো থাকতে পরিবেশের ভালো চাওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।’

শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) ঢাকা লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে ‘হাচ ক্রসওয়ার্ড অ্যাওয়ার্ড ফর ফিকশন’ জয়ী উপন্যাস ‘দি হাংরি টাইড’ নিয়ে আলোচনার সেশনে তিনি এসব কথা বলেন।

সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ মনে করেন, ‘কলোনিয়ালিজমের আগ্রাসন পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপের জনগোষ্ঠীকে হত্যা করে ও দাস বানিয়ে দাস মশলা ব্যবসায় ডাচদের আধিপত্য অর্জিত হয়। শুধু তখন নয়, জীবাশ্ম জ্বালানি ও উদ্ভিদ-কেন্দ্রিক রাজনীতি সবসময়ই প্রাসঙ্গিক ছিল। আমাদের শেখানো হয়েছে শিল্পায়ন বা ব্যাবসার মতো কেবলই মানবকেন্দ্রিক ধারণা ‘উন্নতি’ বা ‘উন্নয়ন’, যেখানে কোনও আত্মিক সংযোগ নেই।’
 
ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক ও প্রযোজক সাদাফ সায্-এর সঞ্চলনায় সেশনটি উপন্যাসের নামকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও কেবল এখানেই আলোচনা থেমে থাকেনি। এই আলোচনায় নিজ শেকড় থেকে শুরু করে উঠে এসেছে বর্তমান পরিবেশ সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, বাংলা সাহিত্য এবং উন্নয়নের ধারণার সাথে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের নানা অসঙ্গতি।

পদ্মাপার থেকে ইতালির ভেনিস, মাঝে বিহারে যাত্রাবিরতি। অমিতাভ ঘোষের শৈশবে উত্তরাধিকারসূত্রে শেকড় থেকে পাওয়া আড়িয়াল খাঁ, কীর্তিনাশা, উন্মত্ত পদ্মার নামগুলোকে তিনি ধারণ করেন। পদ্মার কোলে ঢলে পড়া মাটিতে তার আদিনিবাস। নদীর এই উন্মত্ততার মুখোমুখি হতে হলেও লেখকের মননে নদী ও পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি।

সুন্দরবন নিয়ে ‘দি হাংরি টাইড’ বইটি লেখার সময় তাকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা ও জীববৈচিত্র‍্যের সংকট নিয়ে ভাবতে হয়েছে। তিনি মনে করেন, ‘ঐতিহাসিকভাবেই মানুষ পরিবেশের ক্ষতিসাধন করছে। কিন্তু বর্তমানে এর মাত্রা বিপজ্জনক হারে বেড়েছে। পশ্চিমে যতো সহজে ঐতিহাসিক বিষয়ে নানান তথ্য পাওয়া যায়, আমাদের অঞ্চলে তা পাওয়া ততটা সহজ নয়। তাই ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে হলে তথ্য ও কল্পনার সঠিক ভারসাম্য প্রয়োজন।’

বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন পরিবেশে কিছু অদ্ভূত ও অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটছে। কেবল এ অঞ্চলে না, ভেনিস বা মিয়ামিতেও বন্যা হচ্ছে, সান ফ্রান্সিসকোর রাস্তায় ম্যানহোল ফেটে পানির ফোয়ারা উঠছে। এসবের পেছনে মানুষই দায়ী। মানুষ পরিবেশকে যা দিচ্ছে, তা-ই আমাদের এমন অদ্ভূত সব কাণ্ড দেখতে বাধ্য করছে। লেখক মনে করেন, আমাদের এমন পরিস্থিতি মুখে পড়াটা অপ্রিয় সত্য হলেও অবসম্ভাবী হয়ে উঠেছে। লেখকের দায়িত্ব হলো- সত্য যেমনই হোক তা তুলে ধরা।

লেখকের লেখা বই ‘জঙ্গলনামা’ নিয়ে আর্ট পারফর্মও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে সঞ্চালকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা দিন দিন সংগঠিত হওয়ার বদলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। বই পড়ার অভিজ্ঞতাও এখন অনেকটাই ব্যক্তিগত। আগে এমনটা ছিল না। আগুনের পাশে বসে, বাড়িতেই দল বেধে বই পড়া হতো বা কোনও গল্প বলা হতো। গল্পের এই আস্বাদন এখন আগের মতো নেই। সেকারণে, তিনি জঙ্গলনামা বইটি অংশগ্রহণমূলক পারফরমেন্স হিসেবে লিখতে চেয়েছেন।’

বইটি লেখার সময় তার মনে হয়েছিল বর্তমান দক্ষিণ এশীয় ঔপন্যাসিকরা আধুনিক হওয়ার প্রয়াসে পশ্চিমা ধারা অনুসরণ করছেন। কিন্তু জীবন ও পরিবেশের সম্পর্কের জটিলতা এই ধারায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এই অভাববোধ থেকে লেখক শেকড়ের জ্ঞানের সন্ধান করেছেন। তিনি মনসামঙ্গল কাব্য, পদ্মপুরাণ পড়েছেন। তিনি মনে করেন, এই পুরাণগুলোর কাব্যিক ধারা, বর্ণনাভঙ্গি ও চারিত্রিক উপস্থাপন আমাদের জটিল আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট তুলে ধরার জন্য বেশি উপযোগী। শেকড়ের এই অ-আধুনিক ধারা থেকেই তিনি লেখার অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন।