প্রতিরোধের মুখে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠেন ইয়াহিয়া-ভুট্টো

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহকে বলা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের শেষ ধাপ। সেই সময়টায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ব পাকিস্তান। এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেটসহ সারা দেশে নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে গোটা দেশকে রক্তে ভাসিয়ে ভয় দেখাতে উদ্যত পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। গণহত্যার প্রতিবাদে দেশে ও দেশের বাইরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতি। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে শ্রমিক-কৃষক ও ছাত্র-জনতাসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

শাসকগোষ্ঠী এই আন্দোলন দমন করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বর্বরোচিত পন্থায় নিরীহ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো।

ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, টঙ্গীতে এইদিন গুলিবর্ষণে চার জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৮ (পরে আরও বেড়েছিল)। রাজশাহী-রংপুরে আবার কারফিউ জারি করা হয়। এই দিনে ভুট্টোর সঙ্গে ইয়াহিয়ার পাঁচ ঘণ্টা বৈঠক হয়। গভীর রাতে পাওয়া এক খবরে জানা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে পাঁচ ঘণ্টা টানা বৈঠক করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এইদিন তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে। এই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষেরও উচিত গণহত্যা বন্ধের দাবি তোলা।

পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ওয়ালী গ্রুপ) সভাপতি মোজাফ্ফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন যুক্ত বিবৃতি দেন। সেখানে তারা অভিযোগ করেন, ‘পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী দেশে গণতন্ত্র বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করেছে। তারা এ দেশে সর্বত্র একই বর্বরোচিত পন্থায় নিরীহ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এবং গণহত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। এহেন গণহত্যা চলতে থাকলে জনগণের পক্ষে পরিবেশ শান্ত রাখা সম্ভব হবে না। শান্তিপূর্ণভাবে গণ-প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করা ঠিক হয়নি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তিন আসামি স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, এসএম সুলতান উদ্দিন এবং এল এম নূর মোহাম্মদ এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলার স্বাধিকার আদায়ের চূড়ান্ত সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য দলমত নির্বিশেষে বাঙালিদের প্রতি আবেদন জানান। একইসাথে, আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয় পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, শ্রমিক লীগ, শ্রমিক ফেডারেশন, মজদুর ফেডারেশন, নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি, সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি, মহিলা সংসদ, পান রফতানি সমিতি, গণমুক্তি দল ও চলচিত্র সমাজসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন।

বাংলার ৫৫ হাজার বর্গমাইলে জনতার উত্তাল তরঙ্গে ভীত হয়ে সুর নরম করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। আত্মপক্ষ সমর্থন করে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যকার বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্বল্পকালীন স্থগিত ঘোষণার জন্য পিপিপি অনুরোধ জানিয়েছিল এ কথা ঠিক। তবে ইচ্ছা ছিল এই সময়ের মধ্যে ছয় দফা প্রশ্নে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছা যাবে।’

কিন্তু বাংলার প্রতিরোধের মুখে তারা যে যাই বলুন না কেন ওই সময়ে তারা পরিকল্পিত হত্যা নির্যাতনের হার বাড়িয়ে দিয়েছিল উল্লেখ করে ভাটার মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেক হক বলেন, ‘আমরা তখন নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলাম। কী বলবেন বঙ্গবন্ধু। তখন আমাদের সবার মধ্যে উত্তেজনা- ৭ মার্চের প্রস্তুতি চলছে। ওই মাসের শুরুতেই রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করছে। জোটবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ মোকাবিলায় কোনও ধরনের শর্ত ছাড় দিতে হবে তা নিয়ে দলের মধ্যে আলাপ চলছে। আমরা বুঝতে পারছিলাম যুদ্ধ শুরুতে দেরি নেই।