ছক্কার টোটকা দিতে সাকিবের ‘ক্লাস’

সাকিব এগিয়ে এসে লম্বা শটস খেললেন। কিন্তু বাউন্ডারি সীমানা নির্ধারিত না থাকায় বোঝা যাচ্ছিল না ছয় হয়েছে কিনা! সেন্টার উইকেটের পাশে ব্যাটিং করা সাকিব জোর গলায় বললেন, ‘এইটা ছয়, এইটা ছয়।’ কিন্তু সাকিবের কথা লিটন-শান্তরা কোনওভাবেই মানছেন না। এক প্রকার জোর করে সাকিবকে উইকেট থেকে তুলে নিয়ে গেলেন লিটন। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার এভাবে অনুশীলন করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। পুরো দিনের অনুশীলনে অধিনায়কের এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকার ইতিহাস খুব কমই। হয়তো এই সিরিজ থেকেই নতুন সাকিবের দেখা মিলছে!

ওয়ানডে সিরিজ শেষে বাংলাদেশ দল এখন প্রস্তুত হচ্ছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ ঘিরে। বৃহস্পতিবার জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটি অনুষ্ঠিত হবে। বেশ কিছু নতুন ক্রিকেটারদের নিয়ে ম্যাচের আগের দিনটি তারা কঠোর অনুশীলনে কাটিয়েছে। প্রথমে ড্রেসিংরুম প্রান্তের দুটি উইকেট এবং পরে প্রেসবক্স প্রান্তের দুটি উইকেটে শান্ত-রনি-লিটনদের অনুশীলন হয়েছে। সাকিবও ড্রেসিংরুম প্রান্তের উইকেটে অনুশীলন করেছেন। কিছুক্ষণ নেট করে তিনি চলে আসেন সেন্টার উইকেটের পাশের উইকেটে। সেখানে ইফতির থ্রোয়ারে সাকিব রেঞ্জ হিটিং করেছেন।

বেশ কিছুক্ষণ অনুশীলনের পর সেন্টার উইকেটে হাজির হন লিটন দাস, একটু পরে নাজমুল হোসেন শান্ত, রনি তালুকদার, তৌহিদ হৃদয়, আফিফ হোসেনরা ভিড় জমাতে থাকেন। শেষ দিকে নেটে ব্যাটিং সেশন সেরে যোগ দেন শামীম পাটোয়ারীও। এরপর শুরু হয় সাকিবের ‘ওয়ান বল চ্যালেঞ্জ’। একজন থ্রোয়ার স্বল্প গতিতে নন স্ট্রাইকিং প্রান্ত থেকে বল ছুড়ে যাচ্ছিলেন। আর সাকিব-লিটনরা অনুশীলন করছিলেন ছয়ের।

কোথায় মারতে হবে, সেই জায়গাও আগে থেকে ঠিক করা। লংঅন ও লং অফ দিয়ে ছয় মারতে হবে। সবার জন্য বরাদ্ধ ছিল এক বল। ছয় মারতে পারলে দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ের সুযোগ, নয়তো ছেড়ে দিতে হবে ব্যাট। এই ছয় হওয়া নিয়েই সতীর্থদের সঙ্গে ‘মধুর ঝগড়ায়’ লিপ্ত হন সাকিব। যদিও এসব ছিল নিছক মজার ছলে।

রেঞ্জ হিটিং চলে দুই প্রান্ত থেকেই। এক প্রান্তে প্রায় আধঘণ্টা ধরে চলার পর সাকিব আরেক প্রান্তে নিয়ে যান সবাইকে। তখন লং অফে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর সঙ্গে কথা বলছিলেন প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। তাকে ‘হাথু ভাই’ ‘এই কোচ’ বলে সাকিব জায়গা থেকে সরানোর চেষ্টা করছিলেন।

সাকিবই প্রথম হিটিং শুরু করেন। প্রথম বলে মারলেন লং অফে। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়ানো বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড। সাকিব এটাকে ছয় ধরলেও লিটন-শান্তরা কোনও মতেই এটাকে ছয় দেবেন না। এই নিয়ে বাঁধে হট্টগোল! এক পর্যায়ে সাকিবকে অনেকটা জোর করে উইকেটের বাইরে বের করে দেন লিটন-শান্ত। ‘ওয়ান বল চ্যালেঞ্জ’ অনুশীলনে সাকিব লংঅন দিয়ে বেশ কিছু ছক্কা মেরেছেন। কিছু বল চারও হয়েছে। বেশ কিছু ছয় হাঁকিয়েছেন তৌহিদ হৃদয়-রনি তালুকদার। তাছাড়া শান্তও বেশ কিছু ছক্কা মেরেছেন। যদিও শেষ দিকে আগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। সবচেয়ে বেশি জড়তা ছিল আফিফ হোসেনের। বেশ কিছু বল মিস করেছেন।  

আফিফের মতো জড়তা ছিল লিটনেরও। ঠিকঠাক টাইমিং হচ্ছিল না। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর একটি ছক্কা মারতে পেরেছেন। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই ব্যাটারের ফর্ম চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে টিম ম্যানেজমেন্টের। ওয়ানডে সিরিজে তিন ম্যাচে তার ব্যাট থেকে ৭ রান এসেছে।

ছক্কার টোটকা দিতে সাকিবের ‘ক্লাস’ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হতে যাওয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজে লিটন ছন্দে ফিরতে না পারলে ভুগতে হবে দলকে। তৌহিদ হৃদয়তো অফস্ট্যাম্পের বাইরের একটি বল ছেড়ে দিয়েছেন। তার দাবি ছিল ‘ওয়াইড’, কিন্তু সেটি মানতে নারাজ সাকিব। শেষ পর্যন্ত তৌহিদকে ব্যাট ছেড়ে দিতে হয় শামীম হোসেনের কাছে। সবার শেষে ‘ওয়ান বল চ্যালেঞ্জে’ যোগ দেন তিনি। তবে লং-অন দিয়ে বিশাল ছক্কায় চ্যালেঞ্জ জেতেন শামীম। সবকিছু মিলিয়ে সাগরিকায় রেঞ্জ হিটিং সেশন ছিল উৎসবমুখর। সবচেয়ে বেশি সাকিবকেই সরব দেখা গেছে। কিছু না কিছু বলে হাসি-ঠাট্টায় সবাইকে মাতিয়ে রাখছিলেন।

সাকিব অবশ্য শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। প্রত্যেকে কোচ ও ক্রিকেটারের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলেছেন। পেসার কিংবা স্পিনার কেউই সাকিবের এই ‘ক্লাস’ থেকে বাদ পড়েননি। টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক যখন সেন্টার উইকেটে অনুশীলন করছিলেন, ওই সময় সেখানে হাজির হন লিটন। উইকেটকিপার এই ব্যাটারের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপও করেন তিনি। বোঝা যাচ্ছিল, ওয়ানডে সিরিজে রান না পাওয়া লিটনকে প্রেরণা দিচ্ছিলেন।

সাকিবের ক্লাস থেকে বাদ পড়েননি রনি, শান্তরাও। ৮ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুই নম্বর ম্যাচ খেলার সুযোগ রনির সামনে। তার প্রত্যাবর্তনটা কীভাবে স্মরণীয় করা যায়-সেসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে অধিনায়কের। এই পর্ব শুরুর আগে প্রধান কোচ হাথুরুসিংহে, স্পিন বোলিং কোচ রঙ্গনা হেরাথ এবং পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ডের সঙ্গেও সাকিব কথা বলেছেন। এমন সাকিবকে খুব একটা দেখা যায় না।

অবশ্য এই মুহূর্তে দলের একমাত্র সিনিয়র ক্রিকেটার তিনি-ই। ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাট থেকে অবসর নিয়েছেন। পারফরম্যান্সের কারণে বাদ পড়েছেন মাহমুদউল্লাহ। চার সিনিয়র ক্রিকেটারের মধ্যে কেবল সাকিবই এই ফরম্যাটে খেলছেন। এমন পরিস্থিতিতে তরুণদের আত্মবিশ্বাসী করতে অধিনায়ককেই ভূমিকা রাখতে হবে।