চট্টগ্রাম নগরীতে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

চট্টগ্রাম নগরীতে আবারও বেপরোয়া কিশোর গ্যাং। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা এসব কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। নগরীর ১৬ থানা জুড়ে ৫০টির বেশি কিশোর গ্যাং গ্রুপে অন্তত ৩ হাজার কিশোর সক্রিয়। এলাকার মাদক বেচা-কেনা, জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাতে হকার বাণিজ্য, মারামারি, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধে সক্রিয় এসব কিশোর গ্যাং সদস্যরা। কথিত বড় ভাইদের মদদে চলছে তাদের ভয়ানক সব কর্মকাণ্ড।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নগরের চকবাজার এলাকায় দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনায় আহত জিকু নাথের মা অঞ্জনা রানী নাথ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় কিশোর গ্যাংয়ের ১৩ সদস্যকে আসামি করা হয়।

এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় চাঁদা না দেওয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের ছুরিকাঘাতে আজমির হোসেন নামে এক সিএনজি অটোরিকশা চালক আহত হন। এ ঘটনায় আহত অটোরিকশা চালক বাদী হয়ে কিশোর গ্যাং লিডার আজাদসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা হলেও বহাল তবিয়তে আজাদসহ অন্য আসামিরা।

গত বছরের ৮ এপ্রিল নগরের কোতোয়ালি থানাধীন চেরাগী পাহাড় দৈনিক আজাদী গলিতে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের মারামারিতে প্রকাশ্যে কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয় আসকার বিন তারেক নামে এক কিশোরকে। এ ঘটনায় নিহতের পিতা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার আসামিদের অধিকাংশই কিশোর।

এ ঘটনার মাত্র কয়েক শত গজ অদূরে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে  জামালখান মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয় আদনান ইফসারকে। এ মামলায় গ্রেফতার পাঁচ কিশোর হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন।

এছাড়া ওই বছরের ১৫ এপ্রিল নগরের পাহাড়তলী থানার ঈদগাও কাঁচা রাস্তার মোড়ে দুলহান কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে ছুরিকাঘাতে ফাহিম (১৬) নামে গণপূর্ত বিদ্যানিকেতনের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নিহত হন।

বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুর রহিম জানান, গত বছরের ৪ জুলাই রাতে ওই থানার সৈয়দ শাহ রোডের ওয়াপদা গেট এলাকায় মোরশেদ নামে এক ব্যক্তির ভাড়া ঘরে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপের চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় তৈরি টু টু বোর পিস্তল, একটি চাইনিজ কুড়াল ও ৫শ’ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়।

এদিকে, ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরের চকবাজার এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে জড়িত ‘ডট গ্যাং’ নামে পরিচিত একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের লিডারসহ সাত জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক  লে. কর্ণেল মো. মাহবুব আলম বলেন, “কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘ডট গ্যাং’ গত দেড় বছর আগে সৃষ্টি হয়। এ গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্য আগে ‘ছুরিয়াটি’ নামের আরেকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য হিসেবে ছিল। পরবর্তীতে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে তারা আলাদা হয়ে যায়। গ্রুপটির লিডার মিম। তার পিতা একজন চিকিৎসক, মা চাকরিজীবী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট। তার কিশোর গ্যাং গ্রুপে অন্তত ৪০ জন সদস্য রয়েছে। এরমধ্যে সক্রিয় ৮ থেকে ৯ জন। যেখানেই মারামারি কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতো সেখানেই এই গ্রুপের ৮-৯ জনের উপস্থিতি দেখা যেত। মূলত চাঁদাবাজি, জমি দখল, আধিপত্য বিস্তার, ইভটিজিং এবং সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ে  দ্বন্দ্ব এ ধরনের কর্মকাণ্ডসহ গ্রুপটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। এ গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যই ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। এরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্বনামধন্য স্কুলের ছাত্র। তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো ফেসবুকে শেয়ার করতো। অধিকাংশ সদস্যই ‘হিরো ইজম’ বা ‘হিরো’ হয়ে ওঠার প্রবণতা থেকে গ্রুপটিতে যোগদান করে।”

তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৬টি থানা এলাকায় ৫০টির বেশি কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয়। এরমধ্যে একটি গ্রুপের প্রধানসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাঁচটির মতো গ্রুপ সক্রিয় চকবাজার এলাকায়। বাকি গ্রুপগুলোর ওপর নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। এসব গ্রুপের মদদদাতা হিসেবে আমরা তথাকথিত কিছু বড় ভাইয়ের তথ্য পেয়েছি। তাদের অনেকেই সাবেক রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালী। তাদেরকেও আমরা নজরদারিতে রেখেছি।

সিএমপির এডিসি (মিডিয়া) স্পিনা রানী প্রামাণিক বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে নগর পুলিশ অবগত আছে। আমরা নজর রাখছি। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ, ডিবি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছেন।’