কোনও ধরনের উসকানি থেকে বিরত থাকতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ও ঘটনাবহুল। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে মোড় ঘুরতে শুরু করে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা।

১৩ মার্চ ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন সরকার সামরিক ফরমান জারি করে ১৫ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে কর্মীদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড হবে।

সামরিক কর্তৃপক্ষের নতুন নির্দেশের জবাবে ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদমাধ্যমে একটি বিবৃতি দেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ১৩ মার্চের এই বিবৃতিকে ধরে সংবাদ পরিবেশন করা হয় ‘উসকানিমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করুন’- এই শিরোনামে।

তাঁর কথায়, ‘সামরিক আইনের আরেকটি আদেশ জারি হয়েছে— জানতে পেরে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি যখন খোদ সামরিক আইন প্রত্যাহারের জন্য ইতোমধ্যে বাংলার সমগ্র জনমানসের প্রচণ্ড দাবির কথা ঘোষণা করেছি, তখন নতুন করে এমন আদেশ জারি করা জনসাধারণকে উসকানিদানেরই শামিল। যারা এ ধরনের আদেশ জারি করছেন, তাদের এই সত্য উপলব্ধি করা উচিত যে, আজ  জনসাধারণ তাদের ইস্পাত কঠিন সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের মুখে তারা কিছুতেই নতি স্বীকার করবে না।’

সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি উসকানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ‘জনসাধারণকে ভীতি প্রদর্শনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। কারণ, তারা জানে, ঐক্যবদ্ধ মানুষের এই শক্তির বিরুদ্ধে কোনও কিছুরই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুযোগ নাই।’

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী, এদিনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী কাজ চলে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাসভবন, যানবাহনে ওড়ে কালো পতাকা। একাত্তরের মার্চ মাসে যত দিন গড়াচ্ছিল, স্বাধীনতাকামী বাঙালির ঐক্য ততই সুদৃঢ় হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে তখনকার চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড় ও দৃঢ় একাত্মতা ঘোষণা করছিল বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন।

প্রতিদিনের মতো এদিনও ঢাকাসহ বড় শহরগুলো ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মিছিল-সমাবেশে ছিল মুখরিত। ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়ন সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ থেকে বিশাল মশাল মিছিল বের করে। বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মীসহ ২৬৫ জন বিদেশি নাগরিক এদিন ঢাকা ছেড়ে যান।

ইত্তেফাকের সংবাদে পাওয়া তথ্য বলছে, লাহোরে ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচটি পার্লামেন্টারি পার্টির নেতাদের সভায় দেশ থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে দেশের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর ও বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। সভায় যোগ দেয় কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন লীগ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তানের নেতারা।

সভায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্তারিত আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও বর্তমান অচলাবস্থা দূরীকরণের পন্থা উদ্ভাবনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। ওয়ালীপন্থী ন্যাপ আগেই শেখ মুজিবুর রহমানের শর্তের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। ১৩ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগ ছাড়া পাকিস্তানের সব দলই বঙ্গবন্ধুর চার দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

এর আগেও ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে দেশের শিল্পীসমাজ নানা রকমের প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে। এই দিনে চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব ও পদক বর্জন করেন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) প্রাঙ্গণে পরিষদের সব আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক, সম্পাদক ও সদস্যদের সভা আহ্বান করেন।

ইতোমধ্যে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিষদ গঠন করে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার জন্য নারী নেত্রীরা সংগঠিত হয়েছে। এই দিনে চট্টগ্রামে বেগম উমরতুল ফজলের সভাপতিত্বে নারীদের সমাবেশে বাংলাদেশের জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাস দ্রব্য বর্জন ও কালোব্যাজ ধারনের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।